সাড়ে ৫ বছর বয়সে বিশ্বের কনিষ্ঠতম মা
তিনি বিশ্বের কনিষ্ঠতম মা। ১৯৩৯ সালে মাত্র ৫ বছর ৭ মাস ২১ দিন বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি! তার নাম লিনা মেদিনা। পেরুর বাসিন্দা লিনার এই কথা সেসময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাকে ঘিরে নেমেছিল সাংবাদিকদের ঢল। এমনকি নিজেকে নিয়ে একাধিক তথ্যচিত্রের জন্য বড় অংকের টাকার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন তিনি।
অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতি নিয়ে যখন বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকদের মধ্যে টালমাটাল অবস্থা, তখনও এসব কিছু থেকে একেবারেই অজ্ঞাত ছিলেন লিনা। মাত্র সাড়ে ৫ বছরে মা হওয়া এই মেয়েটি তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পুতুল নিয়ে খেলায় ব্যস্ত।
বিজ্ঞাপন
লিনার জন্ম হয়েছিল পেরুর টিক্রাপোতে। তার বাবা ছিলেন টিবুরেলো মেদিনা এবং মা ভিক্টোরিয়া লোসিয়া। লিনারা ছিলেন ৯ ভাই-বোন। তবে অন্যদের তুলনায় লিনা যেন একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছিলেন। বিশেষ করে ওই বয়সে তার স্তনের বৃদ্ধি সকলের চোখে পড়ছিল।
লিনা যখন ৫ বছরের আরও একটি বিষয় নিয়ে সকলেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার পেট ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছিল। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন থেকে চিকিৎসক সকলেই প্রাথমিক ভাবে ভেবেছিলেন পেটে টিউমার হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পিসকো হাসপাতালের চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারেন টিউমার নয়, লিনা গর্ভবতী। তার গর্ভে বড় হচ্ছে সন্তান!
লিনা তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা! আর লিনার বয়স তখন ৫ বছর ৭ মাস ২১ দিন। অর্থাৎ ৫ বছর হওয়ার আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল লিনা! চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর আগে এমন উদাহরণ ছিল না।
এই ঘটনা সামনে আসার সঙ্গে আরও একটি বিষয় সামনে এসেছিল। লিনার ওপর হওয়া যৌন হেনস্থার বিষয়। ছোট্ট লিনার সন্তানের বাবা কে তা নিয়েও শুরু হয় তদন্ত।
এই ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হলে তার বাবাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় একপর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে সময় লিনাও এতোটাই ছোট ছিল যে, সন্তানের বাবা কে- এর তদন্তে কোনো ভাবেই পুলিশকে সাহায্য করতে পারেনি। আজও বিষয়টি রহস্যই রয়ে গেছে।
শেষে অস্ত্রোপচার করে লিনার প্রথম সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করা হয়। নাম রাখা হয় গেরার্ডো। যে চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচার করেছিলেন তারই নামানুসারে। জন্মের সময় সন্তানের ওজন ছিল ২ কেজি ৭০০ গ্রাম। অর্থাৎ স্বাভাবিক ওজন নিয়ে সমস্ত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছিল ছোট্ট লিনা।
ছেলে গেরার্ডোর কাছে লিনার পরিচয় ছিল বড় বোন। গেরার্ডো তার সঙ্গে সে ভাবেই আচরণ করতেন। সারা দিন ‘বোন’র সঙ্গে খেলাধুলা করে, কখনও বা দুষ্টুমি করে দিন কেটে যেত। ১০ বছর বয়স হলে গেরার্ডো জানতে পারে- লিনা আসলে তার মা।
লিনাকে নিয়ে চিকিৎসক মহলে নানা গবেষণা চলেছে। লা প্রেসি মেডিকেল জার্নালে তাকে নিয়ে বিস্তর প্রচ্ছদ প্রকাশিত হয়। তাতে জানা যায়, ৮ মাস বয়স থেকেই ঋতুস্রাব শুরু হয়েছিল তার। অর্থাৎ তখন থেকেই প্রজননশীল হয়ে পড়েছিল সে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলা হয় প্রিকসিয়াস পিউবার্টি। অর্থাৎ সময়ের অনেক আগেই প্রজনন ক্ষমতা প্রাপ্ত হওয়া। মস্তিষ্কের যে অংশ থেকে যৌন হরমোন নিঃসৃত হয়, সেই অংশেরই কিছু সমস্যার কারণে এমনটি ঘটে থাকে। যা বিরল ঘটনা।
পরবর্তীকালে তার চিকিৎসক গেরার্ডো লোজাডার ক্লিনিকেই তিনি সেক্রেটারির কাজ শুরু করেন। উপার্জনের টাকায় ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে শিক্ষিত করেন লিনা। কিন্তু নিজের পরিস্থিতি নিয়ে ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কারও সঙ্গেই আলোচনা করেননি তিনি।
১৯৭০ সালে বিয়ে করেন লিনা। দু’বছর পর তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। আর প্রথম সন্তান গেরার্ডো ১৯৭৯ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে অস্থিমজ্জা সংক্রান্ত রোগে মারা যান।
লিনার বয়স এখন ৮৭ বছর। পেরুতেই থাকেন তিনি। কথা বলার জন্য আজও তাকে খোঁজেন সাংবাদিকরা। কিন্তু প্রথম থেকেই একটি বিষয়ে কঠোর অবস্থানেই আছেন তিনি। আর তা হলো- কখনও নিজের এই বিষয়টি নিয়ে কোনো সাক্ষাৎকার তিনি দেননি। তাই তার এই ঘটনাটি আজও রহস্যে ঘেরা।
টিএম