পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পৃথক হওয়ার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে আগামী ২৬ মার্চ। এমন সময়ে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে, যে দেশটিকে ১৯৭২ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, বিশ্বজুড়ে সফল দেশের গল্পের ক্ষেত্রে ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো হিসেবে কেন দেশটির নাম উদ্ধৃত হচ্ছে? কেন এবং কীভাবে এক সময়ের ‘দরিদ্র’ বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়েও ভালো করছে? বাংলাদেশের কাছ থেকে কী পাকিস্তানের শিক্ষা নেওয়ার কিছু রয়েছে? 

এক সময় বাংলাদেশ ছিল এমন একটি দেশ যেখানে বন্যার ধ্বংসাত্মক হানায় জনজীবন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গোটা দেশ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, বিনষ্ট হয়েছিল দেশটির শান্তি ও স্থিতিশীলতা। কিন্তু আজ সেই দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করেছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়নে অনুমান করা যেতে পারে যে দেশটি এখন আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নেই। বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ পাকিস্তানের দ্বিগুণ এবং তাদের মুদ্রা টাকার ক্ষেত্রেও এর মূল্য পাকিস্তানের রুপির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তানের ১ দশমিক ৫ শতাংশের বিপরীতে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের হাতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তানের ২০ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে ৪১ বিলিয়ন ডলার। পাসপোর্ট সূচক, সাক্ষরতার হার, ক্ষুদ্রঋণ ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। কেবল রেমিটেন্সে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। তবে পাকিস্তানের ২২ কোটির তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪০ লাখ। অথচ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি। 

এগুলো মাথায় রেখে চারটি বিষয়ের কথা তুলে ধরা যায়, যেসব বিষয়ের কারণে এক সময় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আশায় মুখিয়ে থাকা বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে প্রাণবন্ত একটি দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটির উন্নয়ন ব্যাপক ত্বরান্বিত হয়েছে। বিষয়গুলো হলো— নেতৃত্ব, উদ্ভাবন, পরিকল্পনা ও নিজস্ব মালিকানা। বাংলাদেশ কীভাবে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করছে তা বোঝার জন্য তিনটি প্রধান বাস্তবতার বিষয় মাথায় রাখতে পারে পাকিস্তান।  

প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণের উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল দক্ষতা— যা দেশটির পোশাক রফতানি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, উচ্চ সাক্ষরতার হার, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারী ক্ষমতায়নের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে হাজার হাজার পোশাক কারখানা, অথচ দেশটিতে তুলার চাষ তেমন হয় না। তবে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি করে বাংলাদেশি পোশাক কারখানাগুলো ৩৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করছে। বিপরীতে, পাকিস্তান তুলা চাষকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখনো পোশাক ও বস্ত্র রফতানি ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। আরও খারাপ বিষয়টি হলো, পাকিস্তান এখন তুলা আমদানি করছে। প্রকৃতপক্ষে, কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে উদ্ভাবন ও প্রতিশ্রুতির অভাবে পাকিস্তান তার পোশাক ও বস্ত্র রফতানি বাড়াতে নিজেদের কৃষি সম্পদ বিশেষ করে সুতার ব্যবহার করতে পারছে না।

দ্বিতীয়ত, দেশে গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণ সত্ত্বেও অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা এবং সামাজিক ও মানবিক বিকাশের দিকেই বেশি মনযোগী বাংলাদেশ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে আত্মবিশ্বাসের সাথে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে উদযাপিত হবে। তিনি তার ওই সংকল্পের কথা ব্যক্ত করে আরও বলেছিলেন, যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমস্ত অর্থনৈতিক, মানবিক ও সামাজিক উন্নয়নের সূচকের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পরাস্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। বেশ কয়েক বছর আগে শেখ হাসিনার ভবিষ্যদ্বাণী এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে মূলত পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে।

তৃতীয়ত, দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকছেন তারা দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য অবদান রাখার বিষয়ে মনযোগী বলে মনেই হয় না। ফলে অর্থনৈতিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মন্দ প্রশাসন ও সামাজিক বিপর্যয়ে ভুগছে পাকিস্তান। একটি দেশকে সফল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে শুধু সামরিক সামর্থ্য অর্জন যথেষ্ট নয়; বিশেষত যখন অর্থনৈতিক, মানবিক ও সামাজিক বিকাশের সূচক ক্রমশ নিম্নগামী।

ইংরেজি থেকে আংশিক অনূদিত, স্বত্ব: পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন

মুনিস আহমার করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

এএস