তাইগ্রের আহাজারি বিশ্ব শুনতে পাচ্ছে কি?
ইথিওপিয়ার উত্তরের তাইগ্রে অঞ্চলে গত বছর সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে সাংবাদিক ও দাতা সংস্থার প্রবেশাধিকার মারাত্মকভাবে সীমিত করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সেখানে যাওয়ার অনুমতি পান বিবিসির কালকিদান ইয়েবেলতাল। সেখানে যাওয়ার পর তিনি ভয়াবহ এক মানবিক সংকট পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন।
তাইগ্রের শাইর শহরে প্রতিদিনই ছিন্নমূল মানুষের প্রাণহানি বাড়ছে। ছয় বছরের শিশুকন্যা বেটলেহেম টেসফায়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে উত্তর দিকে আনুমানিক ৫০ কিলোমিটার দূরের শহর আকসুমের পাশের এলাকা থেকে এসে এই সংঘাতে দুই পা হারিয়েছে। শাইরের ওই একই বিস্ফোরণে সে তার মাকেও হারিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বেটলেহেমের চিকিৎসার পেছনে নিজের সঞ্চয়ের সবটুকু খরচ করছেন তারা বাবা। এখন তিনি জানেন না যে, কীভাবে তার শিশুকন্যার জন্য দুটি কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করবেন তিনি।
ইথিওপিয়ার সরকার ও টাইগ্রের আঞ্চলিক বাহিনীর মধ্যে এই সংঘাতে গণহত্যা ও পদ্ধতিগত ধর্ষণের মতো আরও নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
এই সংঘাতে বাড়িঘর ছেড়ে তাইগ্রের অন্যান্য ছোট শহরের মতো শাইরেও ছিন্নমূল লাখ লাখ মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা যে সংঘাতের শিকার সেই সংঘাতে গণহত্যা ও পদ্ধতিগত ধর্ষণের মতো আরও নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু মধ্যাঞ্চলীয় দেড় লক্ষাধিক মানুষের এই শহরের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ।
বিগত চার মাস ধরে শাইরে মানুষের ঢল নামলেও এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শহরটি। দুর্ভোগের ‘প্রেক্ষাগৃহে’ পরিণত হয়েছে শাইরের স্কুল ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দাতা সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী শহরটির অস্থায়ী শিবিরে এখন বাস করছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
কেন্দ্রীয় সরকার ও তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) এর মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনার ফল এই সংঘাত। তবে দুই বছর আগেও ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে একক আধিপত্য ছিল টিপিএলএফ-এর।
গত বছরের নভেম্বরে সংঘাত শুরুর পর প্রথমবার সেখানে ছিন্নমূল এসব মানুষ আসতে শুরু করেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ হলেন তাইগ্রের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দা। অঞ্চলটিতে সংঘাত শুরুর দিনগুলোতে এসব এলাকা ছিল লড়াইয়ের কেন্দ্রস্থল। দিনে দিনে সংঘাত যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা।
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং ওই অঞ্চলের সাবেক শাসক অর্থাৎ তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) এর মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনার ফল এই সংঘাত। তবে ২০১৮ সালে আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে একক আধিপত্য ছিল টিপিএলএফ-এর।
তাইগ্রের আঞ্চলিক রাজধানী মেকেল্লেতে সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে হামলা হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ সেখানে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরই বেশ কিছু পক্ষের মধ্যে এই সংঘাতের শুরু। এতে পৃথক পৃথক বেশ কিছু সেনারাও জড়িত। এর মধ্য দিয়ে তাইগ্রেতে সর্বাত্মক এই সংঘাত পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে তাইগ্রের সশস্ত্র বাহিনী পার্শ্ববর্তী আমহারার অঞ্চল থেকে টিপিএলএফের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এদিকে ইথিওপিয়ার সরকারকে সমর্থনের অছিলায় তাইগ্রেতে প্রবেশ করে দীর্ঘদিনের শত্রুদের ওপর ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনী।
পয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা আতসেদে মেব্রাহটম সেবব দিনের কথা ভয়াবহতার সঙ্গে স্মরণ করলেন। দুই মেয়ে ও তাদের পরিবারের সহায়তায় তিনি সেখানকার দানাশা নামের একটি ছোট শহরে বাস করতেন। আতসেদে, তার মেয়ে ও তাদের স্বামী-সন্তানরা এখন শাইর শহরের একটি শিবিরে কোনোমতে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন।
সংঘাতকবলিত এক নারী বলছেন ‘কোথাও একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগও আমরা পাইনি। সবাই চিল তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত। এক টুকরো রুটি চেয়ে নিয়ে বাচ্চাটাকে দিয়েছি। কাপ ধার করে তাতে পানি খাইয়েছি ছোট শিশুটিকে।’
তারা যখন বাড়ি ছেড়ে পালায়, তখন হাতে কোনো অর্থ ছিল না। তারা জানতো না যে তারা কোথায় যাচ্ছে আর এর শেষ কোথায়। প্রয়োজনে তারা হেঁটেছে, লরি ও লোকভর্তি বাসে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়েছে। বাস-লরির ওইসব মানুষের অবস্থাও তাদেরই মতো। তারাও জীবন রক্ষার তাগিদে বাড়ি ছেড়ে অজানার পথে পা বাড়িয়েছেন।
আতসেদে মেব্রাহটম বলছেন, ‘কোথাও একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগও আমরা পাইনি। সবাই চিল তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত। এক টুকরো রুটি চেয়ে নিয়ে বাচ্চাটাকে দিয়েছি। কাপ ধার করে তাতে পানি খাইয়েছি ছোট শিশুটিকে।’ যাওয়ার সময় রাস্তায় মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেও এই দৃশ্য তিনি ভুলতে পারছেন না।
অস্থায়ী এসব শিবিরে কিছু কিছু ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষজন বলছেন, যে চাহিদা তার তুলনায় এটা খুবই কম।
বিবিসির প্রতিনিধিকে পৌঢ় ওই নারী বলেন, ‘আমরা খুব কষ্টে থাকলেও এখনো বেঁচে আছি। একটা একটা করে দিন আসছে আর যাচ্ছে। আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমরা এখনো বেঁচে আছি।’
কেউ কেউ বলছেন, তারা বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তারা যেসব এলাকার বাসিন্দা সেসব এলাকা এখন আমহারার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমহারার আঞ্চলিক সরকার বলছে, ১৯৯০ সালে টিপিএলএফ যখন ক্ষমতায় আসে তখন জোর করে তাদের অঞ্চলের এসব অংশ দখল করে নেওয়া হয়েছিল।
অস্থায়ী এসব শিবিরে কিছু কিছু ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষজন বলছেন, যে চাহিদা তার তুলনায় এটা খুবই কম। সংঘাত শুরু হওয়ার পর অঞ্চলটির দশ লাখের বেশি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
টিপিএলএফকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার তাইগ্রেতে যে অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক সরকার নিয়োগ দিয়েছে সেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অঞ্চলটিতে এখন চল্লিশ লাখের বেশি মানুষের ত্রাণ সহযোগিতা প্রয়োজন; যা ওই অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক।
মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রবেশে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা শিথিল করার জন্য বৈশ্বিকভাবেও আহ্বান জানানো হচ্ছে।
তাইগ্রের অন্তর্বর্তী সরকারের মুখপাত্র ইতেনেশ নিগুসিয়ে বিবিসিকে বলেছেন, দাতা ও মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোর তাদের পদক্ষেপ আরও জোরালো করার প্রয়োজন এখন। মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রবেশে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা শিথিল করার জন্য বৈশ্বিকভাবেও আহ্বান জানানো হচ্ছে।
তিনি একসময় টিপিএলএফ নেতাদের দখল করা রাজধানী মেকেল্লেতে অবস্থিত এক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এখন এসব সংস্থাকে এখানে আসার ও সাহায্য করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এটাই সঠিক সময়। আমরা আশা করছি, সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া সহযোগিতার বাইরে আমাদের প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেবে এসব সংস্থা।’
শাইর শহরে বিবিসির ওই সংবাদদাতা লেটেবেরহান আসিফা নামে আরও একজনের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সুদান ও ইরিত্রিয়া সীমান্ত লাগোয়া ছোট শহর থেকে শাইরে এসেছেন। সেখান থেকে এর দুরত্ব ৪৫০ কিমি।
সংঘাত শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে তার মেয়ের সিজারে বাচ্চা হয়। তারা যখন বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেন তখন তার মেয়ে অনেকটা অসুস্থ। মা হিসেবে অসুস্থ মেয়ের যত্নের সঙ্গে নবজাতককে কোলে নিয়ে পথ চলতে হয় তাকে। শিবিরে আশ্রয় পাওয়ার পর কিছুটা নিরাপদ মনে হলেও জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম করতে হচ্ছে এখন।
পরিস্থিতি এমন হলেও এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাত্রীবোঝাই বাস ও লরি এমনকি ঘোড়ার গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে শাইরে আসছে। সংঘাত শুরুর কয়েকদিনের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকারের সেনারা তাইগ্রের বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরও বাড়িঘর ছেড়ে পালানো এসব মানুষের ঢল কমছে না।
এছাড়া এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধান না মেলায় অনেক স্থানে লড়াই-সংঘাত চিরতরে থেকে যাবে বলেই শঙ্কা।
তবে সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনো ভঙ্গুর। এখনো বিক্ষিপ্তভাবে কিছু এলাকায় বিবদমান পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে। রাতে কারফিউয়ের সঙ্গে জারি রয়েছে জরুরি অবস্থা। অঞ্চলটির এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার জন্য অনেকগুলো তল্লাসি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে।
তবে আপাতত এই লড়াই-সংঘাত যদি বন্ধও হয়ে যায় তারপরও এই ক্ষত শুকাতে বছরের পর বছর সময় লাগবে। এছাড়া এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধান না মেলায় অনেক স্থানে লড়াই-সংঘাত চিরতরে থেকে যাবে বলেই শঙ্কা।
এএস