টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন
তিস্তায় পশ্চিমবঙ্গের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, উৎকণ্ঠায় ঢাকা
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর পানি ঢাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক এই নদীর পানির ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। সেটি খুব একটা সফল হয়নি। এবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সরকার এই নদীর একটি উপনদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের এ পদক্ষেপ ঢাকা তথা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। কারণ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (১৩ মার্চ) ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পিত তিনটি ‘দার্জিলিং প্রজেক্টে’র মধ্যে দু’টি তিস্তায় সেচের পানির পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে, আর সেটিও এমন এক সময় যখন (ডিসেম্বর-এপ্রিল শুষ্ক মৌসুমে) বাংলাদেশে সেচের পানির চাহিদা বেড়ে যায়।
একটি সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা লো ড্যাম প্রজেক্ট (টিএলডিপি)-এর ১ ও ২ প্রকল্পের ওপর বিশদ প্রতিবেদন (ডিপিআর) তৈরির জন্য নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। তিস্তা নদীর উপনদী বড় রংগীত নদীর ওপরে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া এই দুই প্রকল্পে ৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্মিলিত ক্ষমতা থাকবে।
এছাড়া বালাসন ও রংভাং নদীর ওপর বালাসন হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্টের ডিপিআরের জন্য অনুরূপ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও সূত্রটি উল্লেখ করেছে। আর এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৮ মেগাওয়াট।
ওই সূত্রটি বলেছে, ‘অন্যান্য আরও ১০টি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কিত ডিপিআর প্রস্তুত করার জন্যও নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবসম্মত কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
এর মধ্যে টিএলডিপি ১ ও টিএলডিপি ২ প্রকল্প নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ এ দুটি প্রকল্প বড় রংগীত নদীর ওপরে বাস্তবায়ন করা হবে আর এই নদীটি তিস্তার যে অংশ বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে সেই অংশের সঙ্গে যুক্ত।
আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় তিস্তার পানিতে ঢাকার অধিকার আছে। এই নদীর পানির ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা থাকলেও সেসময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়।
মমতা তখন যুক্তি দিয়েছিলেন, তিস্তায় উভয় দেশের সেচের চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পানির অভাব রয়েছে, বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে। দীর্ঘ এক দশকেও তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ না দেখায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা বারবার দিল্লিকে নিজের অস্বস্তির কথা জানিয়েছে। কিন্তু দিল্লি ও কলকাতার সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অন্যদিকে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের অধীনে দুটি খাল খননের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সেচ বিভাগের পরিকল্পনা প্রকাশ্যে আসার পর ঢাকার ক্ষত আরও গভীর হয়েছে। বাংলাদেশের সূত্রের বরাতে ওই প্রতিবেদনে দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় আসতে পারে।
আর এই পরিস্থিতিতে সিকিমের ১১টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরও পশ্চিমবঙ্গের পরিকল্পিত এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঢাকার জন্য আরেকটি খারাপ সংবাদ হিসেবে এসেছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি সংস্থার একটি সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বছরের শেষের দিকে বা আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যর্থতা নিজ দেশে ক্ষমতাসীনদের জন্য সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করে টেলিগ্রাফ।
ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমটি বলছে, বাংলাদেশে পানি একটি আবেগপূর্ণ বিষয়। যদিও পরিকল্পিত জলবিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর সবগুলোই রান-অব-দ্য-রিভার প্রকল্প, যার অর্থ জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য নেওয়া পানি আবার নদীতেই ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু একজন নদী বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত পানি সেচের জন্য পাওয়া যাবে না।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ওই সূত্রটি জানিয়েছে, এই ধরনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য দিনের বেলা নদী থেকে পানি টেনে নেওয়া হয় এবং সন্ধ্যায় যখন বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ অবস্থায় থাকে তখন তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর গভীর রাতে সেই পানি ফের নদীতে ফেরত দেওয়া হয়, কিন্তু সেসময় সেচের জন্য পানির চাহিদা খুব কমই থাকে।
টেলিগ্রাফ বলছে, তিস্তার পানির কম পরিমাণ এবং এর ফলে উর্বর পলির প্রবাহ হ্রাসের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশাল অংশ শুষ্ক ভূমিতে পরিণত হয়েছে, যা চাষের জন্য অনুপযুক্ত। বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে জানিয়েছে, ‘আমরা তিস্তা ইস্যুকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখতে পারি না, কারণ পানির ওপর আমাদের ন্যায্য দাবি রয়েছে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো- এখানে নদীর জীবনের প্রশ্নও জড়িত।’
ভারতীয় নদী বিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করেন, তিস্তাকে সেচ ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করার ওপর অত্যধিক জোর দেওয়া হলে তা নদীটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ভারতীয় সেচের চাহিদা মেটানোর কথা বলে দুটি খাল খননের যে যৌক্তিকতা সম্প্রতি তুলে ধরা হয়েছে তাকে অতিরঞ্জিত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
একটি সূত্র বলেছে, ‘নদীর নিচে জমে থাকা পলি স্থানান্তরের জন্য সেখানে উল্লেখযোগ্য পানি প্রবাহ প্রয়োজন। … এমনকি জীববৈচিত্র্যের জন্যও এই পানি প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেচ এবং বিদ্যুতের জন্য নদী ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায়শই এই দুই ইতিবাচক দিক ভুলে যায় অনেকে।’
তিনি বলেন, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনাকারীদের ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের জোশিমঠ শহরের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কারণ সম্প্রতি ওই শহরের অনেক জমি তলিয়ে গেছে এবং সেখানকার ভবনগুলোও বড় আকারের ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর অনেকে এই বিপর্যয়ের পেছনে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি টানেলকে দায়ী করেছে।
ভারতের একজন নদী বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘এটা মনে রাখেতে হবে, পূর্বাঞ্চলীয় হিমালয় অস্থিতিশীল এবং খুব বেশি বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্যযুক্ত এলাকা। আর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প মানে আরও বেশি বন উজাড় করা এবং ব্লাস্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে টানেল তৈরি করা। আমি মনে করি, প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করার একটা সীমা আছে।’
তবে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের যুক্তি, তাপবিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমাতে জলবিদ্যুতের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। রাজ্যটির একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘প্রতিটি রাজ্যে জলবিদ্যুৎ ক্রয়ের বাধ্যবাধকতা এবং সবুজ-বিদ্যুৎ-উৎপাদনের (নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন) আদেশ রয়েছে। এগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ।’
অবশ্য জোশিমঠ বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোকে ‘সবুজ’ বলা যেতে পারে কি না সেটি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন একজন নদী বিশেষজ্ঞ। তিনি বলছেন, রাজ্য সরকার এবং এনএইচপিসির মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো একে অপরের সাথে পর্যাপ্ত পরামর্শ ছাড়াই তাদের নিজস্ব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো নিয়ে এগিয়ে চলেছে, এটি ‘দুঃখজনক’।
মূলত এনএইচপিসি সিকিমে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। ওই বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘সমস্যা হলো, নদীকে কীভাবে বাঁচানো যায় তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়।’
টিএম