রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ২ লাখ সৈন্য পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভুলভাবে ধরেই নিয়েছিলেন, রুশ সৈন্যরা কয়েক দিনের মধ্যে রাজধানী কিয়েভে প্রবেশ করতে পারবেন এবং দেশটির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সৈন্যদের একের পর এক অপমানজনক পশ্চাদপসরণে একটা বিষয় পরিষ্কার— তার প্রাথমিক আক্রমণের পরিকল্পনা স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।

• ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের প্রধান লক্ষ্য কী?

এমনকি এখনও রাশিয়ার নেতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পর ইউরোপে বৃহত্তম এই আক্রমণকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসাবে বর্ণনা করেন। পূর্ণ-মাত্রার যুদ্ধ না হলেও ইউক্রেনজুড়ে বেসামরিক লোকজনের ওপর বোমা মারা হয়েছে। এই যুদ্ধে এক কোটি ৩০ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় বিদেশে শরণার্থী অথবা নিজ দেশে বাস্তচ্যুত হয়েছেন।

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেনকে ‘নিরস্ত্র ও নাৎসিমুক্ত’ করার লক্ষ্যে দেশটিতে সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দেন। ইউক্রেন দখল করা রাশিয়ার লক্ষ্য নয়, বলেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে রাশিয়া-সমর্থিত ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর দখলকৃত পূর্ব ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানানোর কয়েকদিন পর এই আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেন তিনি।

তিনি আট বছরের ইউক্রেনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা থেকে লোকজনকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও রাশিয়ার এই ধরনের দাবির বাস্তবে কোনও ভিত্তি নেই। তিনি ইউক্রেনে ন্যাটোর পদচিহ্ন রাখতে বাধা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করার আরেকটি উদ্দেশ্যের কথা বলেন তিনি।

রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর হামলায় ইউক্রেনের অনেক শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে

ইউক্রেনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন পুতিনের এজেন্ডায় থাকলেও এ নিয়ে তিনি কখনই উচ্চবাচ্চ্য করেননি। ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘শত্রু পক্ষ আমাকে এক নম্বর টার্গেট নির্ধারণ করেছে। দুই নম্বর টার্গেটে রয়েছে আমার পরিবার। তার উপদেষ্টার মতে— রুশ সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট ভবনে অন্তত দু’বার হামলার চেষ্টা করেছে।

ইউক্রেনীয় নাৎসিরা গণহত্যা চালাচ্ছেন বলে রাশিয়া যে দাবি করে তার ব্যাখ্যায় রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা আরআইএ নভোস্তি বলেছে, নাৎসিমুক্তকরণ অনিবার্যভাবে ইউক্রেনীয়মুক্তকরণও— বাস্তবে আধুনিক ইউক্রেন রাষ্ট্রকে মুছে ফেলা।

গত কয়েক বছর ধরেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে রাষ্ট্র হিসাবে অস্বীকার করে আসছেন। ২০২১ সালে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন, নবম শতাব্দীর শেষের দিকে রুশ এবং ইউক্রেনীয়রা ছিলেন একই জনগোষ্ঠীর মানুষ।

• যেভাবে যুদ্ধের লক্ষ্য পরিবর্তন করেন পুতিন

ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর এক মাস এবং কিয়েভ ও চেরনিহিভের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সৈন্যরা পিছু হটার পর পুতিনের প্রচার-প্রচারণায় যুদ্ধের লক্ষ্য নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। তখন এই যুদ্ধে তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে ‘দনবাসের মুক্তি।’ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের দুটি শিল্প অঞ্চলকে উল্লেখ করে নতুন এই লক্ষ্যের ব্যাপারে কথা বলতে দেখা যায় তাকে।

উত্তর-পূর্বে খারকিভ এবং দক্ষিণে খেরসন থেকেও পিছু হটতে বাধ্য হয় রুশ সৈন্যরা। কিন্তু তার সেই লক্ষ্য অপরিবর্তিত থেকে যায়। তবে খারকিভ ও খেরসনে রুশ সৈন্যরা সামান্য সফলতাও পায়।

ইউক্রেনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা থেকে লোকজনকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন পুতিন

যুদ্ধক্ষেত্রের এসব ধাক্কার পর গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার নেতাকে ইউক্রেনের চারটি প্রদেশ দখলে নেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে দেখা যায়। যদিও পূর্বাঞ্চলের লুহানস্ক বা দোনেৎস্ক, দক্ষিণের খেরসন বা জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের কোনোটিরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি তিনি।

দুর্বল হয়ে পড়া সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়ায় প্রথমবারের মতো সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা দেন। যদিও এই সৈন্য সমাবেশ ছিল আংশিক। তবে প্রায় ৩ লাখ সংরক্ষিত সৈন্য যুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নাম লেখান।

প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার সক্রিয় সম্মুুখসারিতে এখন যুদ্ধ চলছে। আর সময়ের সাথে সাথে রাশিয়ার জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। বিজয়ের সম্ভাবনাকে অনেকটা বিরলও বলা যায়। ঝটিকা অভিযান বলতে যা বোঝানো হয়েছিল তা এখন দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে জিততেই হবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন পশ্চিমা নেতারা। আর ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার বাস্তবসম্মত রাশিয়ান সম্ভাবনা অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে।

গত ডিসেম্বের প্রেসিডেন্ট পুতিন সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, চলমান যুদ্ধ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হতে পারে। পরবর্তীতে তিনি বলেন, সামরিক সংঘাতের উড়ন্ত চাকা ঘোরানো রাশিয়ার লক্ষ্য নয়। তবে এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে। যদিও এই মুহূর্তে তেমন কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না।

একদিন পর যুদ্ধের বর্ষপূর্তি। তার আগে তিনি রাশিয়ার ‘ঐতিহাসিক সীমান্ত’ রক্ষা এবং ‘দনবাস ও নোভোরোসিয়ায় শান্তিপূর্ণ জীবন পুনর্গঠনে’ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের দক্ষিণের অঞ্চলগুলোও তার প্রকল্পের অংশ, ঠিক পূর্বের মতো।

• যুদ্ধে পুতিনের অর্জন কী?

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে অবৈধভাবে রুশ ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে সাফল্যের দাবি করতে পারেন তিনি, তা হলো রাশিয়ার সীমান্ত থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত একটি স্থল সেতু স্থাপন করা। যে কারণে রাশিয়া এখন কের্চ স্ট্রেইটের ওপর নির্মিত সেতুতে নির্ভরশীল নয়।

গত ডিসেম্বের প্রেসিডেন্ট পুতিন সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, চলমান যুদ্ধ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়াও হতে পারে

 

তিনি ‘রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য অর্জন’ হিসাবে মারিউপোল এবং মেলিতোপোল শহরসহ ওই অঞ্চলটি দখলে নেওয়ার কথা বলেছেন। কের্চ স্ট্রেইটের অভ্যন্তরের আজভ সাগর ‘রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সাগরে পরিণত হয়েছে’ বলেও তিনি ঘোষণা দেন। তিনি বলেছেন, এমনকি রাশিয়ান জার পিটার দ্য গ্রেটও এটি করতে পারেননি।

• পুতিন কী ব্যর্থ হয়েছেন?

ক্রিমিয়ার একটি আঞ্চলিক করিডোর দখলে নেওয়ার বাইরে রাশিয়ার রক্তক্ষয়ী ও বিনা ‍উসকানির এই যুদ্ধ নিজের এবং ইউক্রেনের জন্য এক বিপর্যয় তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং অক্ষমতাই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।

মারিউপোলের মতো ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরকে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে, কিয়েভের কাছের বুচাতে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যুদ্ধাপরাধ চালানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক একটি স্বতন্ত্র তদন্ত প্রতিবেদনে রাশিয়ার সৈন্যদেরকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তবে যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক ব্যর্থতা রাশিয়াকে সবচেয়ে দুর্বল হিসাবে উপস্থাপন করেছে:

○ গত নভেম্বরে খেরসন থেকে দিনিপ্রো নদী পেরিয়ে ৩০ হাজার রুশ সৈন্যের পশ্চাদপসরণ একটি কৌশলগত ব্যর্থতা

○ যুদ্ধের শুরুর দিকে কিয়েভের কাছে ৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সাঁজোয়া যানের বহরের দিনের পর দিন পরে থাকাও সামরিক ব্যর্থতা

○ নতুন বছরে মাকিভকাতে ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিপুলসংখ্যক রুশ সৈন্যের মৃত্যুর ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে

○ কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার রণতরী মস্কভার ডুবে যাওয়ার ঘটনাটি আরেকটি প্রতিরক্ষা ব্যর্থতা

ইউক্রেনে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা নিয়ে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সতর্কতা কোনও পাত্তাই পায়নি। বরং পশ্চিমারা ‘যতদিন প্রয়োজন, অস্ত্র সরবরাহ করা হবে’ বলে সহায়তার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে ন্যাটো কখনই বিভক্ত হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন পশ্চিমা এই সামরিক জোটের নেতারা।

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন হাইমারস ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। এর মাঝেই সম্প্রতি জার্মানির তৈরি লিওপার্ড-২ ট্যাংক সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমা নেতাদের প্রতিনিধি হিসাবে চলতি সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিয়েভে জটিল এক সফর করেছেন।

কিন্তু এই যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। দনবাসে লড়াই অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছর ইউক্রেনের সোলেদার শহর দখলে নিয়েছে রাশিয়া। এছাড়া পশ্চিমের প্রধান শহরগুলোতে প্রবেশের জন্য পূর্বের বাখমুত দখল করার এবং গত শরতে নিয়ন্ত্রণ হারানো অঞ্চলের দখল পুনরুদ্ধারের আশা করছে মস্কো।

পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট পুতিন কেবল দনবাস নয়; বরং জাপোরিঝিয়াসহ চারটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারেন। এই শহরগুলোকে তিনি রাশিয়ার অংশ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। প্রয়োজনে সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি এবং যুদ্ধ আরও টেনে নিতে পারেন তিনি।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পারমাণবিক শক্তিশালী দেশ রাশিয়া। পুতিন রাশিয়াকে রক্ষায় এবং দখলকৃত ইউক্রেনীয় ভূমির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের সহজলভ্য সব ধরনের অস্ত্র ব্যবস্থাপনার ব্যবহার করব। এটা কোনও ধরনের ধাপ্পাবাজি নয়।’

রাশিয়া প্রতিবেশী মলদোভার ইউরোপ-পন্থী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে বলে ধারণা করছে কিয়েভ। ইউক্রেন সীমান্তবর্তী মলদোভার বিচ্ছিন্ন অঞ্চল ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার রাশিয়ার সৈন্যদের ঘাঁটি রয়েছে।

• পুতিন কী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন?

৭০ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট পুতিন সামরিক ব্যর্থতা থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে অন্তত রাশিয়ার বাইরে তার কর্তৃত্ব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। যুদ্ধ শুরুর পর নিজ দেশের সীমানার বাইরে হাতেগোনা কয়েকটি সফর করেছেন তিনি।

আর একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ধকল রাশিয়ার অর্থনীতি আপাতত কাটিয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও দেশটির বাজেট ঘাটতি বেড়েছে এবং তেল ও গ্যাসের রাজস্ব আয় নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে তার জনপ্রিয়তা পরিমাপ করার প্রচেষ্টা একটু কঠিনই।

রাশিয়ায় ভিন্নমত পোষণ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেশটির সামরিক বাহিনী সম্পর্কে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানো হলে কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। ক্ষমতাসীন রুশ নেতৃত্বের বিরোধিতাকারীরা হয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন নতুবা প্রধান বিরোধীনেতা অ্যালেক্সি নাভালনির মতো কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। 

• পশ্চিমমুখী ইউক্রেন

চলমান এই যুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। ওই সময় ইউক্রেনের রুশপন্থী নেতা ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি পরিকল্পিত চুক্তি বাতিলে বাধ্য করে মস্কো। এই ঘটনার জেরে প্রতিবাদ শুরু হয়; যা শেষ পর্যন্ত তার পতন ডেকে আনে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নেয় এবং পূর্বে ভূমি দখলের মঞ্চ তৈরি করে।

২০২২ সালে রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর চার মাস পর ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়া হয়। এই প্রার্থিতা দ্রুত অনুমোদনের জন্য চাপ দিচ্ছে কিয়েভ। রাশিয়ার দীর্ঘদিনের নেতা ভ্লাদিমির পুতিন ন্যাটো জোটে ইউক্রেনের প্রবেশ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তবে যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা প্রতিরক্ষা এই জোটকে তার দোষারোপ করার প্রচেষ্টা কিছুটা মিথ্যাচারও।

যুদ্ধের আগে ইউক্রেন কেবল ন্যাটোর বাইরে থাকার জন্য রাশিয়ার সাথে একটি অস্থায়ী চুক্তিতেই সম্মত হয়নি, বরং গত মার্চে ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেনের একটি জোট নিরপেক্ষ, অ-পরমাণু রাষ্ট্র হিসাবে অবস্থান ধরে রাখারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘তার এই প্রস্তাব সত্য এবং অবশ্যই স্বীকৃত।’

রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে বেআইনিভাবে নিজ ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত করার আগ পর্যন্ত পূর্ব প্রান্তে সৈন্য মোতায়েন না করার নীতি বজায় রেখেছিল ন্যাটো

• যুদ্ধের জন্য কী ন্যাটো দায়ী?

বিভিন্ন শহর রক্ষা করার জন্য ন্যাটোর সদস্যরা ক্রমবর্ধমানভাবে ইউক্রেনে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠিয়েছে। একই সাথে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, গোলাবারুদ এবং ড্রোনও সরবরাহ করেছে; যা এই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সহায়তা করেছে।

তবে পশ্চিমা সামরিক এই জোট ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দায়ী নয় এবং দেশটিতে ন্যাটোর কোনও সৈন্য নেই। রাশিয়ার হুমকির প্রতিক্রিয়ায় ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণের বিষয়টি সামনে আসে। কেবল ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আবেদন করেছিল।

পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করাটা রাশিয়ার এক আখ্যান; যা ইউরোপে কিছুটা ভিত্তিও পেয়েছে। যুদ্ধের আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন ন্যাটোকে ১৯৯৭ সালের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার এবং মধ্য ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক অঞ্চল থেকে জোটের সৈন্য, সামরিক অবকাঠামো প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।

তার দৃষ্টিতে পশ্চিমা বিশ্ব ১৯৯০ সালে ন্যাটো ইউরোপের পূর্ব দিকে এক ইঞ্চিও সম্প্রসারিত হবে না প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগের তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভকে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কেবল পূর্ব জার্মানির কথা উল্লেখ করে দুই জার্মানির এক হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ওই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ন্যাটো নেতারা।

পরবর্তীতে গর্বাচেভ বলেছিলেন, সেই সময় ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে বেআইনিভাবে নিজ ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত করার আগ পর্যন্ত পূর্ব প্রান্তে সৈন্য মোতায়েন না করার নীতি বজায় রেখেছিল ন্যাটো।

• বিবিসির পল কিরবির লেখা নিবন্ধের ভাষান্তর।

এসএস