ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে মানুষ, ধ্বংসস্তূপে বোবা কান্না
তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা সাড়ে ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সোমবারের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের নিচে আটকে পড়া শত শত মানুষকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশ দুটির উদ্ধারকারীরা বলেছেন, তীব্র ঠান্ডা এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে লোকজনকে জীবিত উদ্ধারের সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লোকজনকে উদ্ধারে সময়ের বিপরীতে লড়াই করতে হচ্ছে তাদের।
দীর্ঘদিনের যুদ্ধে ইতোমধ্যে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া তুরস্ক সীমান্ত লাগোয়া সিরিয়ার কিছু শহরে ভূমিকম্পের আঘাত অত্যন্ত তীব্র হয়েছে। এসব সীমান্ত এলাকায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে অনেক বেশি। সিরিয়ায় ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া লাখ লাখ মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ জ্বালিয়ে ঠান্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে আন্তর্জাতিক সহায়তা মাত্র পৌঁছাতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞাপন
সময়ের সাথে সাথে ভূমিকম্পের প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মানুষের বেঁচে যাওয়ার অনেক গল্পও প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন সিরিয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে সদ্যোজাত এক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও তার নাভি বাঁধা ছিল মৃত মায়ের সাথে। এই শিশুর মা ভূমিকম্পে মারা গেছেন।
ওই শিশুর এক স্বজন খলিল আল-সুওয়াদি ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, আমরা ধ্বংসস্তূপ খনন করার সময় একটি কণ্ঠ শুনতে পাই। আমরা ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলার পর মৃত মায়ের সাথে নাভি বাঁধা অবস্থায় নবজাতকটিকে পাই। পরে নাভি কেটে তাকে উদ্ধার করা হয়। আমার চাচাতো ভাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
— ANADOLU AGENCY (@anadoluagency) February 8, 2023
বর্তমানে এই শিশুটিই তার পরিবারে একমাত্র জীবিত সদস্য। তার পরিবারের বাকি সদস্যরা সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত জিন্দারিস শহরে ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন।
সোমবার স্থানীয় সময় ভোরের দিকে সিরিয়া ও তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। তখন সেখানে লোকজন ঘুমিয়ে ছিলেন। স্মরণকালের এই ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন।
কেন্দ্রস্থলের কাছের শহর তুরস্কের গাজিয়ানতেপ এবং কাহরামানমারাসে প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা চালিয়েছে এই ভূমিকম্প। এই দুুই শহরের বেশিরভাগ ভবন ধসে পড়েছে।
ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মঙ্গলবার দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ১০টি প্রদেশে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।
• ‘শিশুরা জমে যাচ্ছে’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং উপসাগরীয় দেশগুলোসহ বিশ্বের কয়েক ডজন দেশ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারী দল ও ত্রাণ সরবরাহ আকাশপথে পৌঁছাতে শুরু করেছে।
কিন্তু সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, তাদের রক্ষা করার প্রচেষ্টা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। তুরস্কের কাহরামানমারাস শহরের বাসিন্দা আলি সাগিরোগলু বলেন, ‘আমি আমার ভাইকে ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিরে পাব না; আমি আমার ভাগ্নেকে ফিরে পাব না। চারপাশে দেখুন, এখানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা নেই।’
— ANADOLU AGENCY (@anadoluagency) February 8, 2023
তিনি বলেন, ‘দুই দিন ধরে আমরা এখানে সরকারি কাউকে দেখতে পাইনি... শিশুরা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে।’
শীতকালীন ঝড় তুরস্কের অনেক রাস্তায় দুর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছে— ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক সড়ক প্রায় চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কিছু অঞ্চলে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় আসা লোকজনের জন্য নতুন বিপদ তৈরি করেছে শীতল বৃষ্টি আর তুষারপাত। লাখ লাখ মানুষ দেশটির মসজিদ, স্কুল, এমনকি বাস স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। আর ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়া অনেকে এখনও উদ্ধারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তবে তাদের জীবিত উদ্ধারের আশা দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে বলে তুর্কি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানোম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এখন সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। আহত এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য আমরা জরুরি মেডিকেল টিমের নেটওয়ার্ক চালু করেছি।
• ভূমিকম্পের প্রভাব পড়বে কোটি কোটি মানুষের ওপর
বুধবার পর্যন্ত দুই দেশে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের ঘরে পৌঁছেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
— ANADOLU AGENCY (@anadoluagency) February 8, 2023
তুরস্কে ধসে পড়া বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তুপ থেকে প্রায় ৭ হাজার ১০০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আর সিরিয়ায় উদ্ধার করা মরদেহের সংখ্যা আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
যদিও দুই দেশে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ডব্লিউএইচওর কর্মকর্তারা মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ভয়াবহ এই ভূমিকম্প ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দেশগুলোকে দুর্যোগকবলিত এলাকায় সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
• তাদের কণ্ঠ ভেসে আসছে
‘আমার পুরো পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে— আমার ছেলেরা, আমার মেয়ে, আমার শাশুড়ি... তাদের বের করে আনার আর কেউ নেই,’ রক্তমাখা মুখ নিয়ে তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পশমের শালে জড়ানো আলী বাত্তাল কান্না করতে করতে এসব কথা বলেন।
৬০ বছর বয়সের কোটায় থাকা এই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি তাদের কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি। আমি জানি, তারা জীবিত। কিন্তু কেউই তাদের উদ্ধার করছেন না।’
সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা ও তারতুস প্রদেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে। মর্মান্তিক এই ঘটনার আগেও সিরিয়ার যুদ্ধ পূর্ববর্তী বাণিজ্যিক কেন্দ্র আলেপ্পোর বেশিরভাগ স্থাপনাই ছিল জরাজীর্ণ।
ভূমিকম্পের পর দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি প্রায় ভঙ্গুর কারাগার থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রায় ২০ সদস্য পালিয়ে গেছে।
বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে তুরস্কের অবস্থান। এর আগে ১৯৩৯ সালে দেশটিতে সোমবারের মতো ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। ওই ভূমিকম্পে দেশটির পূর্ব এরজিনকান প্রদেশে অন্তত ৩৩ হাজার মানুষ নিহত হয়।
এরপর ১৯৯৯ সালে তুরস্কের ডুজসে অঞ্চলে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।
এসএস