তুরস্কে বেঁচে ফেরাদের বেছে নিতে হচ্ছে যেকোনো একটি বিপদ
যেদিকে চোখ যাচ্ছে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর লাশের সারি। গত দুই দিন ধরে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ইউরোপ-এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ তুরস্কের দৃশ্য এটি। যা ফুটে উঠছে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে আসা ছবিতে।
ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই নতুন বিপদে পড়েছে দেশটির অনেক মানুষ। একদিকে বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা আর বৃষ্টি, অপরদিকে একের পর এক আফটার শকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এক কথায় বলতে গেলে, মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থা হয়েছে দেশটির মানুষের। মৃত্যুপুরীর মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য বেছে নিতে হচ্ছে একটি বিপদ।
বিজ্ঞাপন
ভূমিকম্প কবলিত এলাকাগুলোর অধিকাংশ মানুষ পুনর্বাসন কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশটির অনেক মসজিদ, স্টেডিয়াম, কমিউনিটি সেন্টারকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়েছে।
তুরস্কের আদানা শহরের বাসিন্দা উম্মু বায়রা আক্তার এবং নাজিফ বাতমাজ। সোমবারের ভূমিকম্পে তাদের বাড়িঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আশ্রয় নিয়েছেন শহরের একটি মসজিদে।
আদানার ১০ তলা একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপের সামনে এ দুই বাসিন্দার সাথে কথা হয় বিবিসির প্রতিবেদকের। এ সময় প্রচণ্ড শীতে কম্বলে মোড়ানো ছিলেন ওই দুই নারী। বন্ধুদের খুঁজতে বেরিয়েছেন তারা। নিখোঁজদের একজন উম্মু বায়রা আক্তারের চাচাতো ভাই। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানকার একটি ভবনের ফাটল গুরুতর হওয়ায় তাদের সরিয়ে দেন উদ্ধারকারীরা।
এরপরই রাস্তার পাশে আরেকটি জট চোখ পড়ে। যেখানে কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আগুনের তাপ নিচ্ছিলেন বেঁচে ফেরা একদল মানুষ। সেখানেই ওই দুই নারীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় নিখোঁজ বন্ধু নুরটেনের। যিনি হিমশীতল ঠান্ডায় কম্বলে জড়িয়ে বসে কাঁদছিলেন।
তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধসে পড়া ভবনের দ্বিতীয় তলায় আটকা পড়েছে তার মেয়ে সনা। সারাদিন অপেক্ষার পরও মেয়ের কোনও খবর পাননি তিনি। এসময় তিনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার মেয়ে যখন ঠান্ডায় শুয়ে আছে, আমি কীভাবে গরম বিছানায় শুয়ে থাকব?’
কান্নারত এ নারী বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমার মেয়ে ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। অথচ সে মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।’
এদিকে তুরস্কের দক্ষিণে সিরিয়ার সাথে সীমান্ত এলাকার অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি হাতায় প্রদেশ। সেখান থেকে অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনার খবর আসছে। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, অন্ধকারে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করছেন এক বাসিন্দা। তার বিশ্বাস নিচে কেউ জীবিত আছেন।
তিনি বলেন, এখানে একটি মরদেহ পড়ে আছে। কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধারে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। একইসঙ্গে নিচ থেকে একজন নারীর আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে।
তার কথা বলার সময়ই নিচ থেকে ভেসে আসে ওই নারীর কণ্ঠ। তিনি কাঁদছিলেন আর বিভিন্নভাবে শব্দ করে ওপরে থাকা একজনের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। এককথায় ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে থাকার আকুতি ভেসে আসছিল। কিন্তু ওপরে থাকা ব্যক্তিও প্রায় অসহায়। তার একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না। কারণ সম্পূর্ণ বাড়িটি ধসে পড়েছে এবং ধ্বংসাবশেষ থেকে ওই নারীকে বের করে আনতে যন্ত্রপাতির দরকার।
এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে তুরস্কের সীমান্ত অঞ্চলে। যেখানে পৌঁছাচ্ছে না কোনও সাহায্য-সহযোগিতা। অথবা সহযোগিতা থাকলেও এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে চালানো যাচ্ছে না উদ্ধার কার্যক্রম।
পুরো অঞ্চল যেন হাহাকার আর মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ভেসে আসছিল বোবা কান্নার শব্দ। যে কান্না অনেকে শুনতে পেলেও হাত-পা যেন বাঁধা। চোখের সামনে হাহাকার। তবুও চাইলেও যেন কিছুই করার নেই। হাতায়ে শহরেরই আরেক বাসিন্দা ডেনিজ। তিনি ধসে পড়া ভবনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সেখানে তার বাবা-মা আটকা পড়েছেন।
‘তারা চিৎকার করছে, কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসছে না। হে আল্লাহ... বলে তারা ডাকছে। চিৎকার করছে আর বলছে, আমাদের বাঁচাও, কিন্তু আমরা তাদের বাঁচাতে পারছি না। এক কথায় আমরা ধ্বংস হয়েছি,’ বলছিলেন ডেনিজ।
ভূমিকম্প কেন্দ্রের কাছাকাছি আরেক শহর কাহরামানমারাস। যেখানে অসংখ্য ফাটল আর হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
সেখানেই খোলা আকাশের নিচে জড়ো হয়েছে আরেকটি পরিবার। ভূমিকম্পের পর নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেলেও আফটার শকে আবার তারা ঠাঁই নিয়েছে সড়কে। এখন নিজেদের বাড়িতেও ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে পরিবারটি। আবার বাইরেও প্রচণ্ড ঠান্ডা আর বৃষ্টি।
নেসেতগুলার নামের ওই শহরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। চার সন্তানকে নিয়ে শেষ মুহূর্তে ঘর ছেড়েছি। ভেতরে বেশ কয়েকজন আটকা আছে। এখন আমরা পানি আর খাবার ছাড়াই বেঁচে আছি। জানি না আগামীকাল কী হবে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সব অঞ্চলে প্রয়োজনীয় উদ্ধার কার্যক্রম প্রায় অসম্ভব। এখনও অঞ্চলটিতে আরও ভবন ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। আর রাস্তা বা মাঠের পাশে ছোট আগুনই তাদের উষ্ণ থাকার একমাত্র উপায়।
ভূমিকম্পে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাদ যায়নি তুরস্কের মালতায়া প্রদেশ। এই শহরে ৪৯ জন নিহত ও ৫৫০ জন আহত হয়েছেন। শহরের ৩০০ ভবন ধ্বংস হয়েছে। শহরের ঐতিহাসিক ইয়েনি মসজিদটিও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মালতিয়া প্রদেশের প্রতীক হয়ে ওঠা ১২৩ বছর বয়সী ওই মসজিদের বেশ ক্ষতি হয়েছে। মসজিদটি ২০২০ সালের ২৪ জানুয়ারি ইলাজিগের সিভরিস জেলায় সংঘটিত ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এমজে