পেঁয়াজ যেভাবে বিলাসজাত পণ্য হয়ে উঠল ফিলিপাইনে
‘খাবারের ওপর কাটা পেঁয়াজ/ বেরেস্তা দেওয়া সম্ভব নয়’—ফিলিপাইনজুড়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় এখন এমন নোটিশ দেখতে পাওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার তিন লাখ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপদেশটিতে রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম অপরিহার্য মশলা ও সবজি— পেঁয়াজ।
ফিলিপাইনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে দেশটিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০০ পেসোতে, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৩৬০ টাকায়। দেশটিতে এক কেজি মাংসের দামও এখন এর চেয়ে কম। এমনকি ফিলিপাইনে সরকারিভাবে ন্যূনতম যে দৈনিক মজুরি স্বীকৃত, তাকেও ছাড়িয়ে গেছে এক কেজি পেঁয়াজের দাম।
বিজ্ঞাপন
গত কয়েকদিনে অবশ্য দাম খানিকটা কমেছে, তবে তা ফিলিপাইনে পেঁয়াজের বিলাসজাত পণ্যের ‘মর্যাদা’ ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় কেবু শহরে একটি পিজ্জার দোকানের মালিক রিজালদা মাউনেস বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এই কিছুদিন আগেও আমি রেস্তোরাঁর জন্য প্রতি দিন ৩ থেকে ৪ কেজি পেঁয়াজ কিনতাম। এখন দৈনিক আধা কেজি পেঁয়াজে কাজ চালাতে হচ্ছে।’
‘দোকানে যারা খেতে আসেন, তারা অবশ্য অভিযোগ করছেন না। কারণ কেবল রেস্তোরাঁই তো নয়, বাসাবাড়িতে রান্নার সময়ও তারা একই সংকটে ভুগছেন।’
ফিলিপাইনে বর্তমানে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বড় প্রতীক হয়ে উঠেছে পেঁয়াজ। গত ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে খাদ্যপণ্যে, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে ফিলিপাইনে। ডিসেম্বর মাসে যে দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি হয়েছে দেশটিতে, তা ছিল গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোস জুনিয়র একইসঙ্গে দেশটির কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বেও আছেন। খাদ্যপণ্যের এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি থামাতে চলতি জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন তিনি। পাশপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়াতে ব্যাপকভাবে এই মসলাটির আমদানি করার অনুমতিও দিয়েছেন তিনি।
দেশটির অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২২ সালে ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার মতো একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রভাবে কৃষি উৎপাদনে ধস নামার কারণেই আজকের এই পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে ফিলিপাইন।
রাজধানী ম্যানিলাভিত্তিক আইএনজি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নিকোলাস মাপা বিবিসিকে বলেন, ‘দেশে যে খাদ্য সংকট শুরু হতে যাচ্চে, তা গত বছর আগস্টেই কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। সেসময় বলা হয়েছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শীতের দিকে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।’
‘কিন্তু মন্ত্রণালয় এই ঘোষণা দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে দু’টি শক্তিশালী ঝড় আঘাত হানল। ওই ঝড়গুলোর কারণে শীতকালীন আবাদ প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণেই দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে পেঁয়াজসহ বিভিন্ন মসলা ও শাক-সবজি।’
দেশজুড়ে প্রভাব
পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে রেস্তোরাঁর পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কেবুর স্ট্রিটফুডের দোকানগুলোও। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে এসব দোকান ব্যাপক জনপ্রিয়।
স্ট্রিটফুডের দোকানগুলোতে সাধারণত ভাজা সবজি, মাংস ও সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করা হয় এবং খাবার ভেজে পরিবেশনের সময় প্লেটে ভিনিগার মিশ্রিত সসের সঙ্গে কাটা বা ভাজা পেঁয়াজ দেওয়া এসব দোকানের একটি সাধারণ রীতি।
কেবুর একটি স্ট্রিটফুড দোকানের মালিক অ্যালেক্স ছুয়া বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের রান্না প্রণালীতে পেঁয়াজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের মধ্যে যে নোনতা স্বাদ থাকে, তাতে ভারসাম্য আনে পেঁয়াজ।’
‘পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আশা করি, শিগগিরই এটির দাম ফের নাগালের মধ্যে ফিরে আসবে।’
সাধারণ মানুষের মনে পেঁয়াজের দামের এই উল্লম্ফণ কতদূর প্রভাব ফেলেছে— তার খানিকটা আঁচ পাওয়া গেছে ফিলিপাইনের ইলিওলো শহরের তরুণী এপ্রিল লাইকা বিয়োরের সঙ্গে কথা বলার পর। ফিলিপিনো এই তরুণী সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। খ্রিস্টান রীতির বিয়ের অনুষ্ঠানে যাজক বিয়ে পড়ানোর সময় কনের হাতে ফুলের তোড়া থাকতে হয়; কিন্তু বিয়ের দিন বিয়োরের হাতে ছিল ফুলের পরিবর্তে পেঁয়াজের তোড়া।
‘বিয়ের আগে আমি আমার বরকে বলেছিলাম—ফুলের তোড়া তো বিয়ের পরেই নষ্ট হয়ে যাবে; তার চেয়ে বরং আমি পেঁয়াজের তোড়া হাতে নিয়ে বিয়ে করি। বিয়ের পর সেগুলো কাজে লাগবে।’
‘সে (বর) কোনো আপত্তি করেনি, বরং আমার প্রস্তাবে খুশি হয়েছে,’ বিবিসিকে বলেন বিরোরে।
এছাড়া ফিলিপাইনে পেঁয়াজের এই আকালে অন্য দেশ থেকে পাচার হয়েও পেঁয়াজ আসছে। এ মাসের শুরুর দিকে ফিলিপাইন এয়ারলাইন্সের ১০ জন ক্রুকে লাগেজে করে প্রায় ৪০ কেজি পেঁয়াজ আনার অভিযোগে তদন্তের মুখে পড়তে হয়।
শুল্ক কর্মকর্তারা অবশ্য পরে বলেছিলেন, লাগেজে করে পেঁয়াজ আনায় ওই ক্রুদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তারা নিচ্ছেন না। তবে যাত্রীরা যেন অনুমতি ছাড়া পণ্য না আনেন, সে বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন তারা।
সঙ্কট বাড়ছে
পেঁয়াজের এই সংকট প্রেসিডেন্ট মার্কোসকেও কাপে ফেলে দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখে তিনি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন সংসদ সদস্যদের অনেকেই অন্য কাউকে কৃষির দায়িত্ব দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ে সম্প্রতি আইনসভা সিনেটে এক শুনানির আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে সিনেটসদস্য গ্রেস পো বলেন, ‘আগে ছিল চিনি, এখন পেঁয়াজ। রান্নাঘরের বিষয় নিয়ে শুনানি করতে করতেই আমাদের দিন শেষ হবে।’
ফিলিপাইনভিত্তিক অর্থনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কান্টার ওয়ার্ল্ডপ্যানেল কনসালটেন্সির কর্মকর্তা মেরি-অ্যান লেজোরাইন বলেন, ফিলিপাইনের মত দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনও একটি বড় হুমকি৷
‘ক্রেতাদের বেশিরভাগের ক্রয়ক্ষমতা তো সীমিত। এখন তাদের কেবল অতি জরুরি জিনিসপত্র কেনার দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য ঘাটতি আর দাম যদি আরো বাড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে,’ বিবিসিকে বলেন লেজোরাইন।
এসএমডব্লিউ