প্রত্যেক বছর বিশ্বজুড়ে শত শত অভিবাসী অভিবাসনের সময় নিখোঁজ হন। সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে। কারণ এটি সবচেয়ে মারাত্মক পথ। নিখোঁজ প্রিয়জনের আত্মীয়রা সাহায্যের জন্য কোথায় যেতে পারেন? এই নিয়ে আজকের প্রতিবেদন।

হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে যান। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সহিংসতা এবং যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসেন। ভূমধ্যসাগরের মতো বিপজ্জনক পথে জীবনের ঝুঁকি নেন। 

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মতে, বেশিরভাগ সমুদ্র পারাপার হয় ছোট নৌকায়; যা সমুদ্রে চলার উপযোগী নয়। অনেক নৌকা ডুবে যায় এবং অভিবাসীদের কারও দেহ মেলে, কেউ সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যান।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংক্রান্ত সংস্থা আইওএমের ‘মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট’ একমাত্র ডেটাবেস যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসী মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করে। আইনি পরিস্থিতি নির্বিশেষে একটি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে অভিবাসনের সময় মৃত্যু হওয়া ব্যক্তিদের রেকর্ড রাখে তারা। আইওএম ডেটা ইউরোপের পথে সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগরীয় রুটটিকে সবচেয়ে মারাত্মক রুট হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ২০১৪ সাল থেকে এই পথে অন্তত ২০ হাজার ২১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

শুধুমাত্র ২০২২ সালে ভূমধ্যসাগরে প্রায় ২ হাজার অভিবাসীর মৃত্যু এবং নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানিয়েছে তারা। বেশিরভাগ সময় নিখোঁজ ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায় না। অনেক সময় মৃতদেহ মেলে না। পরিবারগুলো বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে। অনুসন্ধানেও দেরি হয়ে যায়।

প্রত্যেক নিখোঁজ অভিবাসীর পরিবারের কেউ না কেউ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন: প্রিয়জন কি জীবিত নাকি মৃত?

• উত্তর খোঁজা এবং জানার অধিকার

নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত অভিবাসনের জন্য গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অনুচ্ছেদে (৮) এই ‘জানার অধিকারের’ বিষয়টি উল্লেখ করেছে। সেখানে মৃত বা নিখোঁজদের শনাক্ত করতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

আইওএমের নিখোঁজ অভিবাসী প্রকল্পের ডেটা বিশ্লেষক মেরনা আবদেলাজিম ব্যাখ্যা করেছেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের হিসাব রাখতে এবং পরিবারকে তাদের সম্পর্কে যেকোনও তথ্য দিতে দেশগুলোকে অবশ্যই যথাযথ সব ব্যবস্থা নিতে হবে।

এর মধ্যে রয়েছে, জাতীয়তা এবং অভিবাসন পরিস্থিতি নির্বিশেষে মৃতদের সন্ধান করা, সংগ্রহ করা এবং প্রত্যাবর্তন করা, দেহ দাফনের আগে সব তথ্য সংগ্রহ এবং দেহাবশেষ শনাক্ত করার সম্ভাবনা নিশ্চিত করা।

দুর্ভাগ্যবশত, অনেক পরিবারের সদস্য অভিবাসনের সময় প্রিয়জনকে হারালেও কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে ভয় পান। কোনো ক্ষেত্রে সে দেশে তাদের নিজস্ব অভিবাসন অবস্থা বা প্রিয়জনদের অনিয়মিত অভিবাসনের কারণে তারা আতঙ্কে থাকেন।

আবদেলাজিম বলেন, অধিকাংশ দেশে অনিয়মিত বসবাস বা চলাচল অপরাধ বিবেচিত হয়। মানবাধিকারের বিবেচনায় তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। সহায়তা পাওয়ার অধিকারও রয়েছে।

নিখোঁজ অভিবাসীদের বেশিরভাগ পরিবার জানে না কীভাবে কোথায় থেকে তাদের অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। বিশেষ করে যখন প্রিয়জনরা বিদেশে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন, তখন আন্তর্জাতিক আইন, একাধিক ভাষা এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্তরগুলো বুঝতে পারেন না তারা।

এমন সংস্থা রয়েছে যা অনুসন্ধানকে সংগঠিত করতে এবং পরিকল্পনা করতে সাহায্য করতে পারে।

• কীভাবে অনুসন্ধান শুরু করতে হবে?

বোটস ফর পিপল পরিবারের জন্য তথ্য নির্দেশিকা (ইটালি)

প্রিয়জন এবং তাদের যাত্রাপথ সম্পর্কে উপলব্ধ তথ্য সংগ্রহ করা প্রথম পদক্ষেপ। সংস্থার আন্তর্জাতিক জোট সেই সব ব্যক্তিদের সন্ধান করছে যারা ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইটালিতে গিয়ে মারা গিয়েছে বা নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য একটি নির্দেশিকা একত্রিত করেছে।

নির্দেশনাটি ইতালি, ফরাসি, ইংরেজি, আরবি এবং তিগ্রিগনা ভাষায় পাওয়া যায়। নিখোঁজ আত্মীয়, প্রয়োজনীয় নথিপত্র এবং তাদের যাতায়াতের বিশদ বিবরণ তালিকাভুক্ত করে এটি। ইতালি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রিয়জনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে রিপোর্ট করতে হবে।

বি৪পি তথ্য নির্দেশিকা পিডিএফ আকারে অনলাইন ইন্টারেক্টিভ গাইড হিসাবে পাওয়া যায়।

• নিখোঁজ অভিবাসীদের পরিবারের অভিজ্ঞতা নিয়ে আইওএম রিপোর্ট

ইথিওপিয়া, যুক্তরাজ্য, স্পেন এবং জিম্বাবুয়েজুড়ে নিখোঁজ অভিবাসীদের ৭৬টি পরিবার একটি প্রতিবেদনে তাদের দুঃখের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে।

‘নিখোঁজ অভিবাসীদের পরিবার: উত্তরের জন্য তাদের অনুসন্ধান এবং ক্ষতির প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কীভাবে পরিবারগুলো বিভিন্ন উৎস যেমন পারিবারিক নেটওয়ার্ক এবং প্রবাসী সম্প্রদায়, চোরাচালানকারী এবং অভিবাসী যাত্রার সহায়তাকারী, সোশ্যাল মিডিয়া, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র-আনুষঙ্গিক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহের জন্য মানবিক সংস্থাগুলোর কাছে গিয়েছে তা বর্ণনা করে।

পরিবারগুলো অনুসন্ধান পরিকল্পনা তৈরি করতে এসব উৎস মিলিয়ে-মিশিয়ে ব্যবহার করে। তাদের অভিজ্ঞতা অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করার জন্য রেফারেন্স হিসাবে কাজ করতে পারে।

• কে সাহায্য করতে পারে?

পারিবারিক সংগঠন এবং তাদের সহায়ক

আইওএমের ‘মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট’র গবেষণায় দেখা গেছে, রাষ্ট্রের সাহায্য সেভাবে না পেলেও অনুসন্ধানে অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্কগুলো থেকে সমর্থন পাওয়া সম্ভব। যার মধ্যে অন্যান্য অভিবাসী, অ্যাক্টিভিস্ট এবং তৃণমূলস্তরের সম্প্রদায়-ভিত্তিক সমিতি রয়েছে।

আবদেলাজিম বলেছেন, কখনও কখনও তারা একত্রিত হবে এবং নিখোঁজদের পরিবারের একটি সমিতি বা সমষ্টি গঠন করবে। মানসিকভাবে পাশে থাকবে সবাই। পরিবার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট দেশে যায়, সম্মিলিতভাবে আইনজীবী বা তদন্তকারীদের অর্থায়ন করে বা বিভিন্ন উৎস থেকে তারা যে তথ্য সংগ্রহ করেছে তা একত্রিত করে।

আবদেলাজিমের কথায়, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পারিবারিক মেলামেশা একে অপরের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র সন্তানহারা মা অপর সন্তানহারা মায়ের শোকের সমব্যথী হতে পারেন। পরিবারকে সাহায্য করা সংস্থাগুলোকে অপরাধী প্রতিপন্ন করার পরিবর্তে সমর্থন করা উচিত। শোকের সময় পাশে থাকা উচিত।’

পরিবারকে সাহায্য করা সংস্থাগুলো মানসিক, আর্থিক এবং নৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি সংহতির অনুভূতি প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আইওএম নথিভুক্ত করেছে। পরিবার সমিতিগুলোর অভিজ্ঞতা এবং সংগঠিত কার্যকলাপ নিয়ে কেস ম্যানেজমেন্ট প্রটোকল দেখার আহ্বান জানানো হয়েছে দেশগুলোকে। ফলে পরিবারের পক্ষে নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান পেতে রিপোর্ট করতেও সুবিধা হয়।

• হাররাগা ​​পরিবারের আন্নাবা কালেকটিভ

আলজেরিয়ান উপভাষায়, হাররাগা ​​শব্দটি এমন কাউকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় যে ‘সীমানা পুড়িয়ে দেয়’ বা এমন কেউ যে কাগজপত্র ছাড়াই দেশত্যাগ করে।

২০০৭ এবং ২০০৮ সালের মধ্যে সন্তানরা সমুদ্রে নিখোঁজ হওয়ার পরে হারাগা পরিবারের অভিভাবকরা আনাবা কালেক্টিভ তৈরি করেছিল। কালেকটিভ কয়েকটি নৌকায় যাত্রীদের একটি তালিকা পুনর্গঠনে কাজ করেছে। মিসিং অ্যাট দ্য বর্ডারস কালেক্টিভ থেকে নিখোঁজ অভিবাসীদের কিছু ছবি সংগ্রহ করে তাদের ওয়েবসাইটে পোস্ট করেছে।

আইনজীবী কউসেইলা জারগুইন অভিযোগ দাখিল করতে এবং ইউনাইটেড নেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ফোর্সড বা অনৈচ্ছিক নিখোঁজদের নিয়ে আবেদন করার জন্য কাজ করেছেন। এর মধ্যে অভিবাসনও রয়েছে।

কামেল বেলাবেদ, মুখপাত্র: + ২১৩৫৫৮ ৮০৫৬৭৩, + ২১৩৬৬১৫৭০২২০, photocompos@gmail.com

কউসেইলা জারগুইন, আইনজীবী: +২১৩৭৯০২০৪৪১২, +২১৩৩৮৫ ৮৫৭৭৮, zerguine-kouceila@hotmail.fr

• নাদোর, মরক্কান অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস (এএমডিএইচ)

তারা মরক্কোতে মৃত বা নিখোঁজ অভিবাসীদের নিয়ে ফেসবুক পেজ চালায়। মৃত বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য পোস্ট করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পরিবারকে নিখোঁজ আত্মীয়দের সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করতে সহায়তা করে।

আপনি যদি এমন কাউকে চেনেন যিনি অভিবাসন যাত্রায় বা নাডোর থেকে স্পেনে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়েছেন, আপনি এএমডিএইচ নাদোরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

• এএমডিএইচ

ফেসবুক পেইজে যোগাযোগ করুন।

• অ্যাসোসিয়েশন লা তেররে পোর টাউস

লা তেররে পোর টাউস তিউনিশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের পরিবার দ্বারা গঠিত হয়েছিল যারা ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হন। তাদের নির্দেশিকা অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।

ইমেল: association_laterrepourtout@yahoo.com

ফেসবুক: https://www.facebook.com/laterrepourtous/

• নিখোঁজ অভিবাসীদের সনাক্তকরণের জন্য আন্তর্জাতিক কেন্দ্র (সিআইপিআইএমডি)

মালাগায় অবস্থিত নিখোঁজ অভিবাসীদের শনাক্তকরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার (সিআইপিআইএমডি) তাদের আত্মীয়দের অনুসন্ধান, সন্ধান এবং শনাক্ত করার জন্য পরিবারের অনুরোধের ভিত্তিতে কাজ করে।

স্পেন, মরক্কো, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম এবং সুইজারল্যান্ডের সহযোগীদের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, সিআইপিআইএমডি মৃত বা নিখোঁজদের শনাক্তকরণে কাজ করছে। আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে একটি ডেটাবেস স্থাপন করছে তারা।

নিখোঁজ আত্মীয় সম্পর্কে তথ্য দিয়ে এই ফরম পূরণ করতে হবে।

• কামিনান্দো ফ্রন্তেরাস

কামিনান্দো ফ্রন্তেরাস অভিবাসী এবং তাদের পরিবারকে সহায়তা প্রদান করে। ঝুঁকির মুখে পড়ে অভিবাসীরা সাহায্য চাইলে সংস্থাটি স্পেন, মরক্কো এবং আলজেরিয়ার সামুদ্রিক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে। তারা অভিবাসীদের আইনি, সামাজিক এবং স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা প্রদান করে এবং ইউরোপীয় ও আফ্রিকান সীমান্তের উভয় দিক থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোকে নথিভুক্ত করে।

মরক্কোতে অভিবাসীদের পরিবারকেও সহায়তা করছে তারা। ২০১৪ সালের ঘটনায় যারা মারা যান, সেইসময় স্প্যানিশ পুলিশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি পদক্ষেপের জন্য কামিনান্দো ফ্রন্তেরাস পাশে ছিল।

• রেতে মিলানো সেনজা ফ্রন্তিয়েরে 

ইতালির মিলানে অ্যাক্টিভিস্ট এবং অ্যাসোসিয়েশনের এই নেটওয়ার্ক অভিবাসী পরিবারগুলোকে সাহায্য ও সহায়তা করে। ২০১৫ সাল থেকে, গ্রুপটি ‘নতুন দেসাপারেসিদোস’র জন্য মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার একটি মিছিল করছে। যেখানে পরিবারের পাঠানো মৃত বা নিখোঁজ অভিবাসীদের ছবি নিয়ে পদযাত্রা হয়। এই পদযাত্রা এখন ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিক্ষোভের সময়সূচি এবং আপডেটের জন্য তাদের ফেসবুক পেজ দেখতে হবে।

• কারোভানে মিগ্রান্তি

২০১৪ সাল থেকে কারোভানে মিগ্রান্তি উত্তর আফ্রিকা থেকে ইতালিতে নিখোঁজ অভিবাসীদের পরিবারের ন্যায়বিচারের আহ্বানকে জোরদার করতে বার্ষিক কাফেলার আয়োজন করে আসছে।

ইতালিতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হলে তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করুন

সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস।

এসএস