‘জিরো কোভিড’ নীতি বাতিলের পর ভজঘট পরিস্থিতিতে চীন
জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভের জেরে চীনের সরকার তাদের বিতর্কিত ‘জিরো কোভিড’ নীতি থেকে সরে আসার পর থেকে রীতিমতো বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশটির জনগণ।
একদিকে রাজধানীসহ বেইজিংসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যায় উল্লম্ফণ ঘটেছে, সেই সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনার বিভিন্ন উপসর্গে ভুগতে থাকা রোগীদের ভীড়।
বিজ্ঞাপন
অতিরিক্ত এই রোগীদের চাপ সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন হাসাপাতালের ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এই কারণে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী হোম আইসোলেশনে আছেন, তাদের অবিলম্বে কাজে যোগ দিতে নোটিশ দিয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু যদি সত্যিই করোনায় আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের সবাই হোম আইসোলেশন ছেড়ে হাসপাতালের কাজে ফিরে আসেন, সেক্ষেত্রে দেশটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন শি চীনের সরকারি স্বাস্থ্যনীতির একজন বিশেষজ্ঞ। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিতে আসেন, সেক্ষেত্রে হাসপাতালগুলো করোনার এপিসেন্টারে পরিণত হবে।’
গত নভেম্বরের শেষ দিকে রাজধানী বেইজিংসহ চীনের বিভিন্ন বড় শহরে সরকারের ‘জিরো কোভিড’ নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের পর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যাবতীয় করোনা বিধিনিষেধ শিথিল করা হয় দেশটিতে। পূর্বের কঠোর করোনা নীতি থেকে কার্যত ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে সরে গিয়ে কল-কারখানা, অফিস-আদালত, বাণিজ্যিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের জনসমাগমপূর্ণ সব স্থান ফের উন্মুক্ত করে দেয় ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার। সামাজিক দূরত্ববিধি ও মাস্ক পরা সম্পর্কিত বাধ্যবাধকতাও তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু তারপর থেকেই রাজধানী বেইজিংসহ চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিন ব্যাপকহারে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা। চেন শি বলেন, চীনের অনেক রোগী করোনার উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও আইসোলেশনে না থেকে জনসমাগমপূর্ণ স্থানগুলোতে অবাধে চলাচল করছেন। মূলত এটিই সাম্প্রতিক উল্লম্ফণের কারণ।
‘মৃদু উপসর্গ থাকলে বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার সংস্কৃতি চীনে নেই। এটা শুধু করোনা নয়, অন্য সব রোগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’
‘চীনের লোকজনের স্বভাব হলো, যখন অসুস্থতা গুরুতর হয়ে উঠবে— তখন চিকিৎসা নিতে যাবে। তার আগ পর্যন্ত শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তারা উদ্বেগ বোধ করে না। সম্প্রতি হাসপাতালগুলোতে যে রোগীর চাপ বাড়ছে— তার একটি বড় কারণ এই প্রবণতা।’
এদিকে, দৈনিক সংক্রমণে উল্লম্ফণ ঘটায় করোনার ওষুধ কিনতে প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে চীনের প্রত্যেক প্রদেশের প্রায় প্রতিটি ওষুধের দোকানে। অনেকে আক্রান্ত রোগীর জন্য ওষুধ কিনছেন, অনেকে আবার ‘ভবিষ্যতে হয়তো ওষুধ পাওয়া যাবে না’— ভীতির কারণে করোনার ওষুধ মজুত করছেন। ফলে অনেক প্রদেশে ইতোমধ্যেই করোনার ওষুধের মজুত শেষ হয়ে গেছে।
রাজধানী বেইজিংয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেইজিংয়ে সব অফিস-আদালত, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কর্মীরা আসছেন না।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্মীদের পুনরায় অফিসে আসতে নোটিশও জারি করেছে কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি আরোপ করছে না। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষই চাইছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর কর্মীরা আসুক। বেইজিংয়ের রেস্তোরাঁ ও সড়কগুলোও ফাঁকা, শান্ত।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে বিশ্বের প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনাটিও ঘটেছিল চীনে।
তারপর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
কিন্তু তাতেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে ওই বছরের ১১ মার্চ করোনাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে ডব্লিউএইচও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারি ঘোষণার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চীনেও দীর্ঘ লকডাউন, সামাজিক দূরত্ববিধি, বাড়ির বাইরে গেলে বাধ্যতামূলক মাস্কপরা, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনসহ কঠোর সব করোনা বিধি জারি করেছিল।
গত ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে অধিকাংশ দেশ করোনা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া শুরু করলেও চীন তার আগের অবস্থানে অনড় ছিল চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত। করোনার বিরুদ্ধে চীন সরকারের এই কঠোর অবস্থান পরিচিতি পায় ‘জিরো কোভিড’ নীতি হিসেবে।
বিবিসিকে চেন শি বলেন, ‘সরকার হঠাৎ করে সব করোনা বিধি শিথিল করেছে, আর তার ফলাফল এই ভজঘট পরিস্থিতি। জিরো কোভিড নীতি থেকে সরার প্রক্রিয়াটি যদি ধীরে ধীরে হতো, তাহলে এই বিপদ ঘটত না।’
এসএমডব্লিউ