টানা প্রায় ১০ মাস ধরে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে রাশিয়া। গত ফেব্রুয়ারিতে এই আগ্রাসন শুরুর পর থেকে সারা বিশ্ব নানামুখী সংকটের মাঝে পড়েছে। তবে অন্য অনেক সংকটের মাঝে পুরো বছরজুড়ে সবচেয়ে সংকটপীড়িত ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে জ্বালানিখাত।

বলা হচ্ছে, জ্বালানি শিল্পের জন্য ২০২২ সালটিকে মনে রাখা হবে। কারণ এই বছরে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটকে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করেছে।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারি থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করা হলেও ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন এবং এর জেরে পশ্চিমা দেশ ও সংস্থাগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আগে থেকেই চাপে থাকা তেল এবং গ্যাস সরবরাহের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে।

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার জেরে বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি সংস্থাগুলো রাশিয়া থেকে বেশ দ্রুত পশ্চাদপসরণ করে এবং (রাশিয়ায়) কয়েক বিলিয়ন ডলারের সম্পদ ফেলে দেশটি থেকে বেরিয়ে যায়। এছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো এটা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী ছিল যে, রাশিয়ার সহযোগিতা ছাড়াই তারা লাইট জ্বালিয়ে রাখতে পারে এবং তাদের বাসিন্দাদের ঠান্ডায় জমে মৃত্যু হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে বহু বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছায় এবং তেলের দাম ব্যারেল প্রতি প্রায় ১৪০ মার্কিন ডলারে পৌঁছে যায়। যা মূলত সর্বকালের রেকর্ড থেকে খুব বেশি দূরে নয় এবং এটিই করোনা মহামারি-পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতিজনিত যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। যা কার্যত অনেক দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

রয়টার্স বলছে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন এবং এর ফলে পরবর্তীতে পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলে কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান বৈশ্বিক-সরবরাহ চেইন ভেঙে যায়। এরপর বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলো জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজে পেতে কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এসময় নিজের আলো জ্বালানোর জন্য যে কোনও কিছু এবং যা কিছু খুঁজে পেতে পারে তা ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ে এসব দেশ। এছাড়া ধনী দেশগুলোর সরকারও সৌর এবং বায়ুচালিত জ্বালানি অবকাঠামো স্থাপনের দিকে জোর দেয়, এমনকি কয়লা কিনতেও। এতে করে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ইতোপূর্বের লক্ষ্যমাত্রা ও এ সংক্রান্ত নানা পদক্ষেপও স্থগিত হয়ে যায়।

অন্যদিকে জার্মানির ইউনিপারের মতো প্রধান প্রধান ইউটিলিটি সংস্থাগুলোকে সহায়তা করার জন্য ধনী দেশগুলোর সরকার বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা তার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হয়েছে। বৈদেশিক রিজার্ভের স্বল্পতার কারণে শ্রীলঙ্কার জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে।

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো এমন একটি দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের পুনঃমূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়, যে দেশটি দীর্ঘকাল ধরে ওই মহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাথমিক ও প্রধান সরবরাহকারী ছিল।

মূলত পশ্চিমা দেশগুলো তখন থেকে (রুশ নির্ভরতা থেকে বের হওয়ার বিষয়ে) আলোচনা করছে এবং রাশিয়ান তেলের দামের সীমা কার্যকর করতে শুরু করেছে। একই সময়ে গ্যাসের মূল্য বেঁধে দেওয়া নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি) আরও বেশি বিনিয়োগ করছে ইউরোপ।

এসএন্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটসের বিশেষ উপদেষ্টা এবং বৈশ্বিক গ্যাস বিশ্লেষক মাইকেল স্টপার্ড বলেছেন, ‘আমরা রাশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে গ্যাস নিয়ে ৫০-বছরের সফল অংশীদারিত্বের সমাপ্তির চেয়ে কম কিছুই দেখছি না। এই সংকটটি আমাদের সরবরাহ এবং চাহিদার পুনর্নির্মাণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা ২০২৩ সাল ও এমনকি এরপরও এর যন্ত্রণা ভোগ করব।’

অবশ্য একটি বৈপরীত্য অনেক দেশে স্পষ্ট। বরঅ হচ্ছে, তাপ পাম্প যোগ করার ক্ষেত্রে পোল্যান্ড হলো ইউরোপের দ্রুততম বর্ধনশীল বাজার। একই সময়ে, ধোঁয়া সীমিত করার আগের নিয়মগুলো স্থগিত করা হয়েছে এবং বাসিন্দারা তাদের ঘর গরম করার জন্য ক্ষতিকারক লিগনাইট তেল এবং আবর্জনাসহ যে কোনও উপকরণ ক্রমবর্ধমানভাবে পোড়াচ্ছে।

দক্ষিণ-পশ্চিম পোল্যান্ডের ক্লোডজকো শহরে ২৮ হাজার মানুষ বসবাস করেন। এই শহরের মেয়র মিশাল পিসকো বলছেন, এখানকার লোকেরা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য আবর্জনা সঞ্চয় করছে।

২০২৩ সালে কী হতে পারে?
বিশৃঙ্খলা শেষ হয়নি। বিশ্বের প্রধান শিল্পোন্নত অর্থনীতিগুলো ২০২৩ সালেও জ্বালানি সরবরাহের সীমাবদ্ধতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোর সরকার খোলাখুলিভাবে মিত্রদের কাছে কৌশলগত সরবরাহের ‘ফ্রেন্ডশোরিং’ সমর্থন করার দিকে সরে গেছে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য উচ্চ খরচ এবং পারমাণবিক, সৌর, বায়ু ও হাইড্রোজেন সম্পদ বিকাশের জন্য ট্যাক্স এবং সহায়তা প্যাকেজগুলোর ব্যবহারও বাড়ানো হয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বিদ্যুৎ সংস্থা ইতালির এনেল। সংস্থাটির সিইও ফ্রান্সেস্কো স্টারেস বলছেন, ‘এটিকে প্রাথমিক বছর হিসাবে গণ্য করা হবে, বা সত্যিই একটি সম্পূর্ণ নতুন সিস্টেমের সূচনা হবে। ২০২২ সাল এবং ২০২৩ সালের একটি অংশে আমরা সবাই বলব, এই সময়েই সকল পরিণতিমূলক ঘটনা ঘটেছিল। এটি অভ্যাস ভাঙার এবং খুব স্পষ্টভাবে পরিবর্তনের বছর।’

মূলত বছর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ঘর গরম করার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু মানুষ এখনও লড়াই করছে এবং কিছু সময়ের জন্য এই খরচ চালিয়ে নিতে পারে। কারণ জ্বালানির স্বল্প সরবরাহ এটির দাম আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রিতে বসবাস করেন রুথ জোহান নামে এক বেকার ব্যক্তি। শীতের মধ্যে প্রয়োজন হলেও তিনি তার পুরো ঘর গরম করার সামর্থ্য রাখেন না। রুথ জোহান বলছেন, ‘আমি যে ঘরে আছি কেবল সেই ঘরটিই গরম করি এবং আর সেটিও আমি কেবল এক ঘণ্টার জন্য করে থাকি। তারপরে আমি একটি জাম্পার, টুপি এবং কোট পরে বসে থাকি।’

সূত্র: রয়টার্স

টিএম