২০২১ এবং ’২২ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্য, বাসস্থান, পরিবহন ও জ্বালানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, গত কয়েক দশকে এমন দেখেনি বিশ্ববাসী। ফলে, বৈশ্বিক জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য যোগাড় করতে গিয়ে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছেন বর্তমানে।

তবে দরজায় কড়া নাড়তে থাকা ২০২৩ সালে যে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে— এমন কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা। বরং তাদের আশঙ্কা আগামী বছর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।

অবশ্য বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা সংস্থা আইএমএফ জানিয়েছে, বড় কোনো বৈশ্বিক দুর্যোগ না ঘটলে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, অর্থাৎ বর্তমানের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে।

কিন্তু আমরা কী করে আজকের এই দুর্যোগের মধ্যে পড়লাম— প্রশ্নের উত্তরে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, করোনা মহামারি ও (রাশিয়া-ইউক্রেন) যুদ্ধ— এ দু’টি শব্দের মধ্যেই নিহিত আছে এ প্রশ্নের উত্তর।

গত কয়েক দশক ধরে নিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন ব্যাংক সুদের হারের মধ্যে সুখে-দুঃখে দিন গুজরান করেছে বিশ্ববাসী। এই স্থিতাবস্থায় প্রথম আঘাত আসে ২০২০ সালে; করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর। শ্বাসতন্ত্রের এই প্রাণঘাতী রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ, লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ জারি করেছিল।

উন্নত দেশগুলোতে লকডাউন ও করোনা বিধিনিষেধের জেরে কর্মহীন হয়ে পড়া জনসাধারণকে খাদ্য ও আবাসন ব্যয় নির্বাহে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এই বাবদ ২০২০ ও ২০২১ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ কোটি ডলার সরবরাহ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এই সহায়তার কারণে উন্নত দেশগুলোর সাধারণ জনগণ ২০২০ সালে মহামারির ভয়াবতার আঁচ সেভাবে পাননি; কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া শুরু করে ২০২১ সাল থেকে— যখন মহামারির স্থবিরতা ভেঙে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ফের শুরু হয় বিশ্বজুড়ে।

দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার ফলে যে ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে, ২০২১ সালে অর্থনীতির পুরোপুরি চালু হওয়া সত্ত্বেও দ্রুত ছন্দে ফিরতে পারেনি বৈশ্বিক অর্থনীতি। খুচরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড-পরিবহন-স্বাস্থ্যসেবা খাতে জনবলের সংকট, কারখানাগুলোতে জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যাওয়া সেই সঙ্গে জ্বালানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি এই ছন্দে না ফিরতে পারার প্রধান কারণ।

কিন্তু তারপরও হয়তো ২০২১ সালের শেষ কিংবা ২০২২ সালের শুরুর মধ্যে অনেকাংশে মহামারীপূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে পারত বৈশ্বিক অর্থনীতি; কিন্তু সেটি সম্ভব হলো না কেবল একটি কারণে— রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি পণ্যের দামে যে ঊর্ধ্বগতি, তার জন্য অনেকাংশে দায়ী চলতি বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর শুরু হওয়া বিশেষ সামরিক অভিযান এবং এই তার জেরে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধজ্ঞা জারি।

সংকটের মূলে জ্বালানির দামবৃদ্ধি

করোনা মহামারির সময় সরকারি প্রণোদনা ও নিজেদের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে প্রায় নিশ্চিন্তভাবেই সে দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পেরেছিলেন উন্নত দেশের নাগরিকরা। দরিদ্র দেশগুলোর জনগণের সেসব সুবিধা না থাকায় মহামারির সময় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল তাদের।

২০২২ সালে সেই ভোগান্তি আরও বেড়েছে। গত ২০২১ সাল থেকে ’২২ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কা, হাইতি, সুদান, লেবাননসহ আরও কিছু দেশ রীতিমতো দেউলিয়া হয়ে গেছে।

কিন্তু জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সেই সংকটের আঁচ অনুভব করছে উন্নত দেশগুলোও। কারণ, কেবলমাত্র এই কারণে উত্তর গোলার্ধজুড়ে খাদ্যপণ্য, আবাসন, পরিবহনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ছে, ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ।

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অধিক মজুরির দাবিতে উন্নত বিভিন্ন দেশে পরিষেবা খাতের কর্মীরা ঘন ঘন ধর্মঘটে যাচ্ছেন, ফলে সামাজিক অস্থিরতা শুরুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে অনেক দেশে।

বিশেষ করে ব্যাপক চাপে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর সরকার। কারণ তাদের একদিকে যেমন জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় সীমিত রাখতে মনযোগ দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনেকে কোটি কোটি ডলারের আর্থিক ও সামরিক সহায়তাও দিতে হচ্ছে।

এদিকে জাতিসংঘের বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীন লোকজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ৭ কোটি মানুষ। ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ‘ক্ষুধার সুনামি’ বয়ে গেছে।

পরিত্রাণ মিলবে ২০২৩ সালে?

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। এই পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ২০২৩ সালের শেষ দিকে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, অর্থাৎ বর্তমান সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের শীর্ষ নির্বাহী জেরোমি প’ওয়েল ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ক্রিস্টিনে ল্যাগার্দে রয়টার্সকে জানিয়েছেন, বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিতে লাগাম দিতে বাধ্য হয়ে ব্যাংকঋণের বিপরীতে সুদের হার বাড়িয়েছেন তারা।

এবং  ইউক্রেনের যুদ্ধ ও চীনের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর উত্তেজনার প্রশমণ যদি শিগগির হ্রাস না পায়, সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে এই পদক্ষেপ কোনো কাজে আসবে কিনা— সে সম্পর্কে তারা নিজেরাও সন্দিহান।

আইএমএফের নিয়মিত মাসিক প্রকাশনার অক্টোবর সংস্করণে বলা হয়েছে, ‘সংক্ষেপে, বিশ্বের অধিকাংশ জনগণ— যাদের এখনও চুড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকটের অভিজ্ঞতা নেই, ২০২৩ সালে সেই অভিজ্ঞতা লাভের সমূহ শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন তারা।’

সূত্র : রয়টার্স

এসএমডব্লিউ