ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে চীনা আক্রমণের শঙ্কায় তাইওয়ান
তাইওয়ান ইস্যুতে বছরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে বারবারই। পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপ ভূখণ্ডটিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর রাজনীতিকের সফর এবং এর জেরে ভূখণ্ডটির চারপাশে চীনের জোরালো সামরিক মহড়ায় উত্তেজনার পারদ বেড়েছে আরও।
এই পরিস্থিতিতে চীনের ‘সম্ভাব্য আক্রমণের’ আশঙ্কা করছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট। এমনকি বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে নাকি বারবারই সেই ধরনের ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি। শনিবার (১২ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় বার্তাসংস্থ এএনআই এবং রুশ বার্তাসংস্থা আরটি।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকান ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিক তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের এক বিবৃতিকে উদ্ধৃত করে বলেছে, তাইওয়ানে চীনা আক্রমণের ‘প্রকৃত হুমকি’ প্রকাশ করেছেন তিনি।
বার্তাসংস্থা আরটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তৃতা লেখক এবং উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডসের লেখা একটি নিবন্ধও উদ্ধৃত করেছে। সেই নিবন্ধে সাই বলেছেন, তাদের সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘এটা বাস্তব যে, এই ঘটনাটি (চীনা আক্রমণ) আমাদের সাথে ঘটতে পারে। এ বিষয়ে সত্যিকারের হুমকি রয়েছে। এটি হাইপ নয়।’
আরটি বলছে, যদিও চীনের সামরিক শক্তি তাইওয়ানের তুলনায় অনেক বেশি তারপরও তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তার শাসনামলে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা ব্যয় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৩ সালে সেই ব্যয় আরও ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে সম্ভাব্য যেকোনও আগ্রাসনের ঘটনায় চীনকে যেন বিশাল মূল্য চোকাতে হয় সেই লক্ষ্য নিয়ে রেখেছে তাইওয়ান। আরটি নিউজে হোয়াইট হাউসের সাবেক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট সাই বলেছেন, ‘যদি (পিপলস লিবারেশন আর্মি) কঠোর কিছু করতে চায়, তাহলে (চীনা প্রেসিডেন্ট) শি জিনপিংকে তার মূল্য চোকাতে হবে। তাকে (সম্ভাব্য যেকোনও হামলার বিষয়ে) দু’বার ভাবতে হবে।’
অবশ্য তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্র তাইপেইকে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেওয়ার পরেও নিজেদের সামরিক বাহিনীর অর্থের যোগানের জন্য তাইওয়ানকে পশ্চিমাদের দরকার হবে, ঠিক যেমন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের জন্য করছে।
নিবন্ধে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের লেখা বক্তব্যের বরাত দিয়ে আরটি নিউজ বলেছে, ‘পশ্চিমা দেশগুলো — বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র — ইউক্রেনকে সাহায্য করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো- পশ্চিমা দেশগুলো একত্রিত হয়ে ইউক্রেনকে যুদ্ধে সাহায্য করছে।’
আরটি রিপোর্ট করেছে, মার্কিন উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডসের সঙ্গে তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের কথোপকথনের পরপরই চীন তার দ্বিবার্ষিক এয়ার শো শুরু করে। এতে চীন ড্রোন-বিধ্বংসী অস্ত্র, পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এবং হাইপারসনিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল প্রদর্শন করে।
আরটি নিউজ এজেন্সি বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে সামরিক পেশীর এই প্রদর্শনকে তাইওয়ানের সঙ্গে চীনা মূল ভূখণ্ডের পুনঃএকত্রীকরণে হস্তক্ষেপ না করার জন্য পশ্চিমের জন্য একটি সতর্কতা হিসাবে অভিহিত করেছে।
এর আগে গত সোমবার ব্রিটিশ বাণিজ্য নীতি মন্ত্রী গ্রেগ হ্যান্ডসের তাইওয়ান সফরের নিন্দা জানায় চীন। চীন সেসময় জানায়, লন্ডন ও তাইওয়ান অঞ্চলের মধ্যে যেকোনও ধরনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগকে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে বেইজিং।
নিয়মিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনও দেশের তাইওয়ানের সাথে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগকে বেইজিং দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অধীনে চীন অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় তাইওয়ানের প্রতি আরও কঠোর নীতি অবলম্বন করছে এবং বেইজিং প্রায়ই দাবি করে আসছে, দ্বীপটি একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ যা শেষ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে ‘পুনরায় একীভূত’ হবে।
উল্লেখ্য, তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে। তাইওয়ান পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ, যা তাইওয়ান প্রণালীর পূর্বে চীনা মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। অবশ্য তাইওয়ানকে বরাবরই নিজেদের একটি প্রদেশ বলে মনে করে থাকে বেইজিং।
গত বছরের অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, মূল ভূখণ্ডের সাথে তাইওয়ানের পুনরেকত্রীকরণ অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। এজন্য সামরিক পথে অগ্রসর হওয়ার বিষয়টিও খোলা রেখেছে বেইজিং।
অন্যদিকে চীনের প্রদেশ নয়, বরং নিজেকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে মনে করে থাকে তাইওয়ান। চীনা প্রেসিডেন্টের এমন মন্তব্যের জবাবে সেসময় তাইওয়ান জানায়, দেশের ভবিষ্যৎ তার জনগণের হাতেই থাকবে।
তবে তাইওয়ানকে চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে বেইজিংয়ের চেষ্টার কমতি নেই। তাইওয়ান উপত্যাকার চারদিকে সামরিক কর্মকাণ্ড জোরদার করেছে চীন। এমনকি গত বছরের মতো চলতি বছরের শুরু থেকেই তাইওয়ানের এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন (এডিআইজেড) লঙ্ঘন করে আসছে বৈশ্বিক এই পরাশক্তি দেশটি।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করার পর তাইওয়ান দেশটির মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও তাইওয়ানকে বরাবরই নিজেদের একটি প্রদেশ বলে মনে করে থাকে বেইজিং। এরপর থেকে তাইওয়ান নিজস্ব সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে।
টিএম