পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান (ফাইল ছবি)

আগাম নির্বাচনের দাবিতে আয়োজিত লংমার্চে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় গুলিতে আহত হয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই প্রধান ইমরান খান। বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) দেশটির পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।

প্রকাশ্য দিবালোকে ইমরান খানকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হত্যার প্রচেষ্টা এবং এই ঘটনায় ইমরানের দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সামনে এনেছে। আর তা হলো- ইমরান খানের ওপর হামলার এই ঘটনাটি পাকিস্তানের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক পদ্ধতিতে কী অর্থ বহন করে। একইসঙ্গে এই হামলা পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে?

পাকিস্তানের প্রধান সারির গণমাধ্যম দ্য ডন বৃহস্পতিবার এ নিয়ে বিশ্লেষকদের সাথে কথা বলেছে। এই বিশ্লেষকদের মধ্যে বিস্তৃত যে ঐকমত্যটি রয়েছে, তা হলো- ইমরানের ওপর আক্রমণটি গত কয়েক বছরে ‘রাজনীতিতে প্রবেশ করা ঘৃণার’ কারণে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

বিশেষ করে চলতি বছরের এপ্রিলে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর রাজনীতিতে ঘৃণা আরও বেড়ে যায়। এই ধরনের ঘটনা পরিস্থিতিকে কেবল আরও খারাপ করবে এবং দেশকে ‘রাজনৈতিক উপজাতিবাদের’ দিকে পরিচালিত করবে, যা পাকিস্তানের সামাজিক কাঠামোকে আরও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ এশিয়া সেন্টার অব দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো সুজা নওয়াজ বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানে এখন কোনও রাজনৈতিক সংলাপ বা আলোচনা নেই। দেশের দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলছে। এই ধরনের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

আরও পড়ুন : পাকিস্তানের বিপজ্জনক রাজনীতি 

তিনি আরও বলেন, ‘তবে, ইমরানের ওপর হামলার ঘটনাটির একটি পূর্ণ ও স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন, আর সেটি প্রথমে পাঞ্জাব সরকার এবং পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করতে পারে। এছাড়া হামলায় ব্যবহৃত গুলি ও অস্ত্রের ফরেনসিক পরীক্ষার প্রমাণ প্রয়োজন। অন্যথায়, পাকিস্তানে আরও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা দেশকে আরও অর্থনৈতিক অশান্তির দিকে নিয়ে যাবে।’

পাকিস্তান সরাইকি পার্টির চেয়ারপার্সন ও শিক্ষাবিদ নুখবাহ তাজ লাঙ্গাহও সুজা নওয়াজের বক্তব্যকে সমর্থন করছেন। তিনি বলছেন: ‘রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেওয়া ঘৃণার এই রেখা আরও গভীর হবে এবং রাজনীতি নতুন করে তলানিতে ঠেকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

তিনি বলছেন, ‘পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই জটিল আকার ধারণ করেছে কারণ দলগুলো রাজনৈতিক যুক্তি ও পদ্ধতি মানতে রাজি নয়। আমরা যাকে রাজনৈতিক সংলাপ বা বক্তৃতা বলি, তেমন কিছু পাকিস্তানে খুব কমই রয়েছে। এগুলোকে কেবল অসহিষ্ণুতা এবং ঘৃণা বলা যায়, যা কেবলই বাড়বে।’

গত এক মাসে দুই সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের একজন কেনিয়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এবং অন্যজন লংমার্চে ইমরান খানের বহনকারী কন্টেইনারে চাপা পড়ে মারা গেছেন। আর এখন ওয়াজিরাবাদে একজন জাতীয় নেতাকে গুলি করা হলো। লাঙ্গাহর আশঙ্কা, ‘জীবন দিন দিন সস্তা হয়ে উঠছে এবং যদি এই প্রবণতা সংশোধন না করা হয় তবে জীবন আরও বেশি সস্তা হয়ে উঠতে পারে।’

ইমরানের ওপর হামলার পর পিটিআইয়ের সিনিয়র নেতা ফাওয়াদ চৌধুরী ঘোষণা করেন, ‘এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা প্রচেষ্টা এবং এখন দলের কর্মীদের সারা দেশে রাস্তায় নেমে প্রতিশোধ নিশ্চিত করা উচিত।’

পরে পিটিআই সেক্রেটারি জেনারেল আসাদ উমর উত্তেজনার মধ্যেই ষড়যন্ত্রমূলক ইন্ধন সামনে আনেন। হামলার কিছু সময় পর একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, পার্টির প্রধান ইমরান খান বিপদমুক্ত এবং তিনি একটি বার্তা দিয়েছেন: ‘আমার ওপর হামলার তথ্য আগে থেকেই ছিল এবং সন্দেহভাজনদের জানতাম।’

এরপর আসাদ উমর তিনজন শীর্ষ সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেন এবং দেশব্যাপী বিক্ষোভ এড়াতে অবিলম্বে তাদের অপসারণের দাবি জানান। এসময় কর্মীদের পরবর্তী প্রতিবাদ আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করা উচিত বলেও জানান তিনি।

পিটিআইয়ের উভয় নেতাই সেই পথই বেছে নিয়েছেন যেটি সাংবাদিক মোশাররফ জাইদি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেন: ‘পিটিআইয়ের বিবৃতিতে অবশ্যই অনেক বেশি ক্ষোভ থাকবে। এটি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) রানা সানাউল্লাহর মতো সরকারি নেতাদের বক্তব্যে আরও ক্ষোভ ও তীব্রতা সৃষ্টি করবে।’

আরও পড়ুন : পাকিস্তান : কান্ট্রি অব থ্রি ‘এ’ 

‘আর এটি কেবল পাকিস্তানকে আরও বিভাজনের দিকে নিয়ে যাবে এবং এতে করে ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে চলে আসা রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের সম্ভাবনাও কমিয়ে দেবে। আর যারা সামরিক একনায়কত্বের ধারণা পোষণ করে তারাই কেবল এই সংকটের একমাত্র সুবিধাভোগী।’

পাঞ্জাবের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রী ও সুপরিচিত শিক্ষাবিদ ডা. হাসান আসকারি রিজভি বর্তমান পরিস্থিতিতে শারীরিক না হলেও আরও মৌখিক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন। তিনি ‘রাজনৈতিক উপজাতিবাদ’ সৃষ্টি এবং রাজনীতিকে আরও নিচের দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করেন।

তিনি বলছেন, ‘ব্যতিক্রম ছাড়া সকল রাজনীতিবিদই এই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন। রাজনীতিবিদরা তাদের ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার অবস্থান থেকে সরে না আসলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, আমরা এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তার চেয়ে অনেক দ্রুত খারাপ হবে।’

প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল বলেছেন, ইমরানের ওপর হামলা ঠিক কীভাবে ঘটেছে তা বলা যায় না, এটি কেবল সুযোগ বুঝে টার্গেটেড হামলাও হতে পারে। যেমন ইমরান খানের আগে অনেক নেতা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বা লিয়াকত আলি খান) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু এখনকার অবস্থা আরও জটিল বলে মনে হয়।

তিনি বলছেন, ‘সাধারণত, লোকেরা রাজনৈতিক মিছিলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নেয় না যদি না তাদের মনে তা ব্যবহারের নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকে। এমনকি হামলাকারী একজন ভাড়া করা ঘাতকও হতে পারে।’

তবে এই হামলার কারণ যাই হোক না কেন, ফলাফল নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানকে কেবল একটি পথেই নিয়ে যাবে: আর তা হলো- আরও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ঘৃণা ও সহিংসতা।

এটি ইমরান খানকে রাজনৈতিকভাবেও সাহায্য করতে পারে, কারণ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ইমরান খানকে এখন নিজের জীবন নিয়ে আরও ঝুঁকি নিতে দেখা যাবে এবং এতে করে আরও ভাসমান ভোটার বিশ্বকাপজয়ী সাবেক এই ক্রিকেটারের পক্ষে চলে আসতে পারেন।

টিএম