ইরানের বিক্ষোভ
‘আগে ভয় পেতাম ফতোয়াকে, এখন সেই ভয় কেটে গেছে’
ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে ২২ বছরের তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে চলমান হিজাববিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে কঠোর পথে হাঁটছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ইরানজুড়ে অন্তত ১০৮ জন নিহত হয়েছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এএফপি।
শুধু তাই নয়, অন্তত ১০০ বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইরান প্রশাসন। এতেও থামানো যায়নি বিক্ষোভ। বরং দমন-নিপীড়নের মধ্যেই বিক্ষোভ অব্যাহত রাখতে চান আন্দোলনকারীরা। তাদের একজন বলছেন, আগে ভয় পেতাম প্রশাসনকে, ফতোয়াকে। এখন সেই ভয় কেটে গেছে।
বিজ্ঞাপন
বিক্ষোভ দমনে ইরানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতার চিত্র পাওয়া যায় আন্দোলনকারীদের কথায়। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় সোরান নামের একজন বন্দুকের নলের ঢঙে দুই আঙুল কপালে ঠেকিয়ে জানান, প্রশ্ন করা তো দূরের কথা, নিছক কথা বললেই ওরা কপালে বুলেট ভরে দিতে পারে।
কাজের খোঁজে সম্প্রতি ইরানের সীমানা পেরিয়ে ইরাকে এসেছেন সোরান। চোখ বুজলে দেখতে পাচ্ছেন নিরাপত্তাবাহিনীর অত্যাচারের ঘটনাগুলো। তিনি বলেন, শুধু মিছিলে পা মিলিয়েছিলাম, সেই ‘দোষেই’ বাহিনী নির্বিচারে মারধর করে আমাকে। চোখের সামনে আমার প্রিয় বন্ধুকে গুলি করে তারা। সোরানের বাড়ি ইরানের কুর্দিস্তানের সক্কেজ শহরে। যে শহরে বাড়ি মাশা আমিনিরও।
প্রায় একই কথা জানান ফারহাদ নামে একজন। তার বাড়ি ইরানের সনন্দাজ শহরে, কর্মসূত্রে থাকেন ইরাকে। আন্দোলনের প্রায় পুরোটা সময়েই ছিলেন ইরানে। নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচারে বলপ্রয়োগ দেখেছেন তিনি।
আরও পড়ুন : ইরানের হিজাববিরোধী বিক্ষোভ: এক মাসে নিহত অন্তত ১০৮
একটি কুর্দিশ মানবাধিকার সংস্থা সূত্রে খবর, চার সপ্তাহের এই আন্দোলনে পশ্চিম ইরানের কুর্দিস্তানে প্রাণ গেছে ৩২ জনের। আহত কমপক্ষে ১৫৪০। ফারহাদের দাবি, সংখ্যাটি আরও বেশি। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, সোমবারই কুর্দিস্তানে হামলায় প্রাণ গেছে ২০ জনের। এমনকি সীমানা পার হওয়ার সময়ও হামলা করছে নিরাপত্তা বাহিনী। তাদের অবশ্য এ নিয়ে মুখ খোলা মানা। কড়া নজরে রেখেছে ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ।
আন্দোলন শুরু থেকেই সক্রিয় ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ। ফলে যার তোলা ছবির সূত্রে ইরানে হিজাববিরোধী আন্দোলনের সূচনা, সেই নারী সাংবাদিক নিলুফার হামেদির দিন কাটছে নিঃসঙ্গ কারাগারে।
বুধবার (১২ অক্টোবর) ইরানের আদালত সূত্রে জানা গেছে, একশরও বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে প্রশাসন। শুধু তেহরান প্রদেশেই বিচার হয়েছে ৬০ জনের। হরমোজগন প্রদেশে অন্তত ৬৫ জনের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর মামলা চলছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ইরানের সংবাদ সংস্থা জানিয়েছিল, হরমোজগন প্রদেশে ৮৮ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর ইরানের উত্তরাংশ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২০০ জনকে, ৬০ জন তাদের মধ্যে নারীও ছিলেন।
১৬ সেপ্টেম্বর মাশা আমিনির মৃত্যুর পরই ইরানজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। তা থামাতেই এত ধরপাকড়-মামলা। হরমোজগান প্রদেশের আদালতের প্রধান বিচারপতি মোজতবা ঘরেমানির দাবি, প্রতিবাদের নামে সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ, সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা, অগ্নিসংযোগ, হিংসা ছড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক পদক্ষেপই করা হচ্ছে।
এতেও প্রতিবাদ থামছে কি? বিক্ষোভকারীদের একাংশের দাবি, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে ভয় দেখিয়ে থামানো যায় না। এমনটা ভাবেন সোরেনও। সংবাদমাধ্যমকে তিনি স্পষ্ট জানালেন— আগে ভয় পেতাম প্রশাসনকে, ফতোয়াকে। এখন সেই ভয় কেটে গেছে। এদিকে, ইউরোপের ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে শুরু করে আমেরিকায় ছড়িয়েছে প্রতিবাদ। সে দেশে বসবাসকারী ইরানিরা পথে নেমেছেন ইরানের আন্দোলনের সমর্থনে। প্রতিবাদ ছড়িয়েছে ভারতেও। ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘সেক্রেড গেমস’-এর ইরানি বংশোদ্ভূত অভিনেত্রী এলনাজ নোরোজি সামাজাক যোগাযোগ মাধ্যমে পোশাক খুলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে দিয়েছেন বার্তা, কী পোশাক পরব তা একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। কোনো প্রশাসন, নীতি পুলিশ তা ঠিক করে দিতে পারে না।
এসএসএইচ