ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সাথে রাশিয়াকে সংযুক্তকারী ইউরোপের বৃহত্তম রেল ও সড়ক সেতুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ইউক্রেনজুড়ে উত্তেজনা আর আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, ইউক্রেন আজ সকালে কার্যত উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে।

রোববার (৯ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত ক্রিমিয়ান সেতুর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে; এটিকে ইতোমধ্যেই গত এপ্রিলে রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ মস্কভা ডুবে যাওয়ার ঘটনার সাথে তুলনা করা হচ্ছে।

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় বলেছে, ‘গাইডেড মিসাইল ক্রুজার মস্কভা এবং কের্চ ব্রিজ - ইউক্রেনীয় ক্রিমিয়াতে রাশিয়ান শক্তির দুটি কুখ্যাত প্রতীক - ধ্বংস হয়ে গেছে। লাইনে এর পরে কি আছে, রাস্কিস?’

এদিকে ইউক্রেনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টরা আনন্দের সাথে এই ঘটনাটি উদযাপন করতে মিম তৈরি করছে। এছাড়া ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ‘মনোব্যাংক’ বলেছে, গাড়িবোমা হামলার পর ভেঙে পড়া এই সেতুর বৈশিষ্ট্যযুক্ত নতুন একটি ডেবিট কার্ড ইতোমধ্যেই ডিজাইন করেছে তারা।

বিবিসি বলছে, ইউক্রেনজুড়ে উত্তেজনার অনুভূতি স্পষ্ট। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেশিরভাগ সময়ই সুসংবাদ পেয়েছে ইউক্রেন। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলো পাল্টা হামলার মাধ্যমে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পুনরুদ্ধারের ঘটনাও রয়েছে। আর এর মধ্যেই জ্বলন্ত এই সেতুর ছবি ইউক্রেনীয় সেনাদের মনোবল বিশাল বৃদ্ধি করবে এটি ধরেই নেওয়া যায়।

সেতুতে হামলার এই ঘটনাটি কিভাবে করা হয়েছিল? ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনীর অভিযান থেকে শুরু করে ক্রিমিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, এমনকি আত্মঘাতী বোমা হামলা পর্যন্ত যে কোনো তত্ত্বই এখন ইউক্রেনজুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক জ্যেষ্ঠ বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘এটি গোপন নাশকতার একটি মাস্টারপিস। নিচ থেকে একটি সুপরিকল্পিত হামলার কারণে এটি হতে পারে।’

অবশ্য ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা গত আগস্টে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান বিমানঘাঁটিতে একটি রহস্যজনক হামলার পর একই মাত্রার অস্পষ্টতা বজায় রেখে শক্তি প্রয়োগ করতে পেরে খুশি। তবে সেই সাকি বিমানঘাঁটি এবং সর্বশেষ এই সেতুতে হামলার ঘটনা মূলত একই বৃহত্তর প্রচেষ্টার একটি অংশ। আর তা হচ্ছে: দক্ষিণ ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য ক্রিমিয়াকে কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করার রাশিয়ার ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করা।

ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে সড়ক ও রেল সেতু রাশিয়ার সামরিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করছে। এই সুবিধা ছাড়া খেরসনের উত্তরে ইউক্রেনের আক্রমণ প্রতিহত করতে মস্কোর জন্য সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো আরও কঠিন হবে।

কিয়েভ মস্কোকেও বলছে: ক্রিমিয়া আমাদের এবং শেষ পর্যন্ত আমরা তা ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছি।

অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে সমস্ত চঞ্চলতা ও আনন্দের মধ্যেও কিছু ইউক্রেনীয় অবশ্য এখন বেশ উদ্বিগ্ন। বিবিসি সংবাদদাতা বলছেন, আজ সকালে আমরা জাপোরিঝিয়া শহর ছেড়েছি। এই শহরেই গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৭ জন বেসামরিক লোক মারা গেছেন।

সেখানকার মানুষের সন্দেহ, তারা রাশিয়ার শাস্তির মুখে পড়ছে। কারণ মস্কোর সাম্প্রতিক সামরিক ব্যর্থতার কারণে হামলার মাধ্যমে যে ক্ষোভ প্রকাশ করছে সেটিরই শিকার হচ্ছে তারা। আর তাই আগামী দিনগুলো আরও অনেক কিছু নিয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দ্বীপের দখল নেয় রাশিয়া। পরে এই দ্বীপের সাথে রাশিয়ার সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য দীর্ঘ ১৯ কিলোমিটার সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ক্রিমিয়া দ্বীপ দখলে নেওয়ার চার বছর পর ২০১৮ সালে সেতুটিকে রাশিয়ার পরিবহন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মহা ধুমধাম করে সেটির উদ্বোধন করেছিলেন।

ইউক্রেন যুদ্ধে এই সেতু রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক সরবরাহ রুটে পরিণত হয়েছে। কারণ ইউক্রেনের দক্ষিণের খেরসন অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা রুশ সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তাদের কাছে অস্ত্র ও সামরিক রসদ পাঠানোর অন্যতম পথ ক্রিমিয়া উপদ্বীপের দীর্ঘ এই সেতুটি।

টিএম