রাশিয়া থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে গেছেন প্রায় দুই লাখ রুশ নাগরিক। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে কেবল কাজাখস্তানেই প্রবেশ করেছেন প্রায় ৯৮ হাজার রাশিয়ান। ইউক্রেনে লড়াইয়ের জন্য আংশিক সৈন্য সমাবেশের ঘোষণার মাধ্যমে রিজার্ভ সেনাদের তলবের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে বিপুল সংখ্যক এসব রাশিয়ান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

কর্মকর্তারা বলেছেন, রিজার্ভ সেনা হিসেবে ডাক এড়াতে চাওয়া এসব পুরুষ স্থল ও আকাশপথে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি আংশিক সেনা সমাবেশের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে ১ লাখ ৯৪ হাজারেরও বেশি রাশিয়ান নাগরিক প্রতিবেশী জর্জিয়া, কাজাখস্তান এবং ফিনল্যান্ডে পালিয়ে গেছেন। পালানো এসব রুশ নাগরিকদের অনেকেই গাড়ি, সাইকেল বা পায়ে হেঁটে এসব দেশে পাড়ি দিয়েছেন।

এপি বলছে, মস্কো থেকে দক্ষিণে অবস্থিত জর্জিয়ার রুশ সীমান্তে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছাতে ভেসেভোলোদ নামে এক রুশ নাগরিকের চার দিন সময় লেগেছে। একপর্যায়ে তাকে গাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলতে হয়। তবে মঙ্গলবার তিনি তার ১৮০০-কিলোমিটার (১১০০-মাইল) যাত্রা শেষ করেন এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের জন্য রিজার্ভ সেনা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া থেকে বাঁচতে সীমান্ত অতিক্রম করেন।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে তিনি বলছেন, ‘২৬ বছর বয়সে আমি একটি জিঙ্ক-লাইনযুক্ত (কফিনে) করে বাড়িতে যেতে চাই না বা সাম্রাজ্য গড়তে চাওয়া একজন ব্যক্তির যুদ্ধের কারণে কারও রক্তের দাগ আমি (আমার) হাতে নিতে চাই না।’

অনলাইন পরিষেবা ইয়ানডেক্স ম্যাপস অনুসারে, মঙ্গলবার রাশিয়ার উত্তর ওসেটিয়া অঞ্চল থেকে জর্জিয়ার সীমান্ত ক্রসিং ভার্খনি লার্সের দিকে ট্রাফিক জ্যামটি প্রায় ১৫ কিলোমিটার (৯ মাইলেরও বেশি) লম্বা অবস্থায় ছিল। রাশিয়ান সীমান্ত রক্ষীরা নিয়ম শিথিল করার পর এবং লোকদের পায়ে হেঁটে সীমান্ত পার হওয়ার অনুমতি দেওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ছবিতে শত শত পথচারীকে চেকপয়েন্টের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

একইভাবে কাজাখস্তানে প্রবেশের জন্য কিছু সীমান্ত ক্রসিংয়েও গাড়ি ও মানুষের দীর্ঘ সারি রয়েছে বলে জানা গেছে। জর্জিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত সপ্তাহ থেকে ৫৩ হজারেরও বেশি রাশিয়ান দেশটিতে প্রবেশ করেছেন।

কাজাখস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে ৯৮ হাজার রাশিয়ান তাদের দেশে প্রবেশ করেছেন। ফিনিশ বর্ডার গার্ড এজেন্সি জানিয়েছে, একই সময়ে ৪৩ হাজার বেশি রুশ নাগরিক তাদের দেশে এসেছে। মিডিয়া রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, আরও ৩ হাজার রাশিয়ান মঙ্গোলিয়ায় প্রবেশ করেছে।

রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের পলায়নের এই স্রোতের প্রবাহকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল। আইনি বিষয়কে উল্লেখ করে তারা কিছু পুরুষকে সীমান্ত পার হতে বাধা দেয়। তবে এটি ব্যাপক আকারে করা হয়েছে বলে মনে হয়নি। অবশ্য গুজব অব্যাহত ছিল যে মস্কো শিগগিরই হয়তো সকল পুরুষ রুশ নাগরিকের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দিতে পারে।

রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কাজাখস্তান এবং জর্জিয়া, উভয় দেশই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। যেসব রুশ নাগরিক গাড়ি, সাইকেল বা পায়ে হেঁটে সীমান্ত পারাপার করছেন তাদের জন্য এই দেশ দু’টিই সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য বলে মনে করা হচ্ছে।

অবশ্য যাদের ফিনল্যান্ড বা নরওয়ের ভিসা আছে তারাও স্থলপথে সেসব দেশে যাচ্ছেন। কারণ বিদেশে যাওয়ার জন্য প্লেনের টিকিট খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে গেছে।

সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। দীর্ঘ এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইউক্রেনে দখল করা ভূখণ্ডগুলো হাতছাড়া হতেই সামরিক গতিবিধি বাড়ানের নির্দেশ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

দেশটিতে নতুন যে সামরিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাতে জানানো হয়েছিল, যাদের সামরিক অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদেরও যুদ্ধে ডাকা হবে। এই পরিস্থিতিতে তরুণ ও যুবক রুশ নাগরিকদের মধ্যে দেশ ছেড়ে পালানোর হিড়িক পড়েছে। এতে করে রুশ সীমান্তে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা।

মঙ্গলবার আলজাজিরা জানায়, রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এড়াতে হাজার হাজার তরুণ দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জর্জিয়া ও ফিনল্যান্ড সীমান্তে দেশত্যাগের জন্য দীর্ঘ সারি তৈরি হয়েছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মী, ব্যাংকার আর গণমাধ্যমকর্মীদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে না বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

এছাড়া রাশিয়ার বাইরে যাওয়া যাবে এমন ফ্লাইটগুলোর টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে এবং সীমান্ত চেকপয়েন্টগুলোতে গাড়ির স্তূপ জমে গেছে। জর্জিয়ার যেতে একমাত্র সীমান্ত রাস্তায় ৪৮ ঘণ্টা ধরে গাড়ির সারি রয়েছে। রাশিয়ার এই প্রতিবেশী দেশটি রুশ নাগরিকদের ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে দেয়।

এপি বলছে, সীমান্ত অতিক্রমকারী রাশিয়ানদের সংখ্যা ঘোষণা করার সময় মঙ্গলবার কাজাখস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মারাত আখমেতজানভ বলেছেন, রিজার্ভ সেনা হিসেবে তলব এড়াতে যারা (কাজাখস্তানে প্রবেশ করছেন) তাদের দেশে (রাশিয়ায়) ফেরত পাঠাবে না কাজাখ কর্তৃপক্ষ। তবে ফৌজদারি অভিযোগের জন্য আন্তর্জাতিক ওয়ান্টেড তালিকায় থাকলে ছাড় দেওয়া হবে না।

কাজাখের প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ ‘বর্তমান হতাশাজনক পরিস্থিতির কারণে’ তার দেশে রাশিয়ানদের প্রবেশে সহায়তা করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই তাদের যত্ন নিতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি রাজনৈতিক এবং মানবিক সমস্যা। আমি সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছি।’

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কাজাখস্তান রাশিয়ার সাথে আলোচনা করবে বলেও জানান তোকায়েভ।

এদিকে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ায় আংশিক সেনা সমাবেশের ঘোষণা দেওয়ার পর সেটিতে কৃষকদেরও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার রুশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই একথা বলেন। আর এতে করে ২০২৩ সালে রাশিয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।

রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ। আর এ কারণে শরৎকাল রুশ কৃষকদের জন্য ব্যস্ত একটি মৌসুম। কারণ এসময়েই কৃষকরা পরের বছরের ফসলের জন্য শীতকালীন গম বপন করে। একইসঙ্গে এসময়ই সয়াবিন ও সূর্যমুখী বীজ সংগ্রহ করে কৃষকরা। তবে বৃষ্টির কারণে ইতোমধ্যেই শীতকালীন শস্য বপন উল্লেখযোগ্যভাবে বিলম্বিত হয়েছে।

মঙ্গলবার পুতিন বলেন, ‘আমি আঞ্চলিক প্রধান এবং কৃষি দপ্তরের প্রধানদের উদ্দেশে কিছু বলতে চাই। আংশিক সেনা সমাবেশের অংশ হিসাবে কৃষি কর্মীদেরও সেটিতে যুক্ত করে খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। তাদের পরিবারকে অবশ্যই সমর্থন করতে হবে। আমি আপনাকে এই বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে বলছি।’

টিএম