ছবি: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও সংকট সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগ্রহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বরং ফিকে হয়ে আসছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট।

রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের কয়েক বছরের মধ্যেই মিয়ানমারে আবারও সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। যদিও মিয়ানমারে সেনাবাহিনী সবসময়ই সবকিছু পরিচালনা করেছে।

অভুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সামরিক সরকার এখন মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থী এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতো কিছুর পরেও মিয়ানমার কিংবা দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো কেন কড়া পদক্ষেপ নিতে পারছে না?

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দেশটির কৌশলগত গুরুত্বই তার প্রধান কারণ।

চীন, জাপান, রাশিয়া এবং ভারতের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক বেশ ভালো। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সদস্য মিয়ানমার। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথেও মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশ - চীন এবং রাশিয়া এ পর্যন্ত কখনও, কোনো ফোরামেই মিয়ানমারের বিপক্ষে যায়নি।

চীনের ব্যাপক স্বার্থ

চীন-মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের জন্য ট্রেনও চালু আছে

চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের ব্যাপক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। আমেরিকার হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে মিয়ানমারের উপর চীনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি।

মিয়ানমারে অবকাঠামো এবং জ্বালানি খাতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। তাছাড়া চীনের অর্থনৈতিক মহাপ্রকল্প বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মিয়ানমার।

ফলে, দশকের পর দশক ধরে অর্থনৈতিক স্বার্থে চীন কখনো মিয়ানমারের সরকারের বিপক্ষে যেতে চায়নি। দেশটিতে যা কিছু ঘটুক না কেন বিনিয়োগ ও ব্যবসার স্বার্থে সেসবের বিরুদ্ধে কখনও কোনো কথা বলেনি চীন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতা নেওয়ার পর গত এক বছরে পরবর্তী এক বছরে মিয়ানমারে ৩৮০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে জান্তা।

এসব বিনিয়োগের মধ্যে চীনের একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস প্ল্যান্ট প্রকল্পও রয়েছে। চীনের এই প্রকল্পটি ২৫০ কোটি ডলারের।তার বাইরে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চীনের ইউনান প্রদেশে একটি জ্বালানি করিডোর স্থাপনের পরিকল্পনাও আছে চীনের।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যদি কোন সংঘাত হয়, তাহলে তারা মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে দেবে এবং  এটা চীন বেশ ভালোভাবেই জানে। সেক্ষেত্রে তারা তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কোথায় পাবে?’

‘চীন প্রচুর তেল-গ্যাস আমদানি করে এবং তার একটি বড় যোগান আসছে মিয়ানমার থেকে।  মিয়ানমার আকিয়াব বন্দরে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে তেল-গ্যাস সরবরাহ করছে মিয়ানমার।’

এসব কারণে মিয়ানমারের প্রতি চীনের সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে বলে মনে করেন হুমায়ুন কবির।

আসিয়ান জোট ও জাপানের সমর্থন

দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে অঞ্চলে সবচেয়ে কার্যকরী অর্থনৈতিক জোট আসিয়ান; কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আসিয়ান মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত কোন অবস্থান নেয়নি। সেটিরও বড় কারণ ব্যবসায়িক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর মিয়ানমারে শীর্ষ বিনিয়োগকারী। মিয়ানমারে সিঙ্গাপুরের অনুমোদিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৪০০ কোটি ডলার। মিয়ানমারে যত বিদেশি বিনিয়োগ আছে তার এক-চতুর্থাংশই সিঙ্গাপুরের।

এছাড়া জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে বলে মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। যদিও জান্তা ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ সার্বিকভাবে কমেছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সূচক।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের মতে, মিয়ানমারের প্রতি জাপানেরও এক ধরনের সমর্থন আছে।

সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে রাশিয়া

জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ টমাস এন্ড্রুস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, চীন এবং রাশিয়া কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে।

জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেছেন, চীন এবং রাশিয়ার পাশাপাশি সার্বিয়াও মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র দিচ্ছে, যদিও তারা জানে যে এসব অস্ত্র বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।

মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার আহবান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গত বছর একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। চীন এবং রাশিয়া ওেই প্রস্তাবে ভোট দান থেকে বিরত ছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, বারবার সেসব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং তার প্রধান কারণ চীন-রাশিয়া।

রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে বিভিন্ন দেশ যখন ব্যাপক সরব ছিল তখন মিয়ানমার প্রসঙ্গে চীন-রাশিয়া কোন উচ্চবাচ্য করেনি, বরং মিয়ানমারের সাথে এ দুটি দেশ বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তারা কখনো মিয়ানমারের নিন্দা করেনি, কিংবা দেশটির সামরিক বাহিনী তাতমাদৌয়ের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমারের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তৈরি হয়েছে। সমরাস্ত্র বেচা-কেনাই এই সম্পর্কের মূলভিত্তি।

ভারতের স্বার্থ কোথায়?

ভারতের সাথে মিয়ানমারের প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে। এছাড়া বঙ্গোবসাগরেও উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে।

ভারত ও মিয়ানমার ১৯৫১ সালে একটি মৈত্রী চুক্তি করেছিল। এই চুক্তির কারণে ২০১৭ সালে তাতমাদৌ রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক নিপীড়ন চালালেও ভারত কড়াভাবে সেটির নিন্দা করতে পারেনি।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারে দমন-পীড়ন নিয়ে ভারত উদ্বেগ জানালেও তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। সেটিও সেই মৈত্রী চুক্তির কারণেই।

রোহিঙ্গা সংকটের শুরুর দিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যত প্রস্তাব এসেছিল সেগুলোতে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত।

ভারতের সাথে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক সম্পর্কও আছে। অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বিনিয়োগ আছে মিয়ানমারে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ এবং বিভিন্ন বিরল প্রাকৃতিক পদার্থ ভারতের তথ্য প্রযুক্তি খাতের জন্য প্রয়োজনীয়। তাছাড়া মিয়ানমারের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মিয়ানমার হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী।

ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যাতে মিয়ানমারে গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও রয়েছে।

তাছাড়া ভারতের এক বড় আশঙ্কার নাম চীন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, চীন যদি মিয়ানমারে একক আধিপত্য পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে মিয়ানমারকে ব্যবহার করে তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

কিছু করতে পারছে না পশ্চিমারাও

মিয়ানমার ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো শক্ত অবস্থানে আছে। রোহিঙ্গা সংকট এবং সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং তাদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছাড়া আর কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

এর পেছনেও একটি দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে চায় না।

দু'হাজার এগারো সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা দেশটিতে ভিড় করতে শুরু করে। মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদের দিকই ছিল তাদের নজর।

জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, হোটেল, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছিল পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশটির মোট জিডিপির ছয় শতাংশই ছিল বিদেশি বিনিয়োগ।

ইউরোপিয়ান কমিশনের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে চীন, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের পরে মিয়ানমারের চতুর্থ ব্যবসায়ী-অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। উভয় পক্ষের মধ্যে বছরে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য হয়।

সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ মোবাইল ফোন পরিষেবা কোম্পানি নরওয়ের টেলিনরও বিনিয়োগ করেছিল। যদিও ২০২১ সালে সামরিক শাসন পুনরায় ফিরে আসার পরে টেলিনর তাদের মিয়ানমারের ব্যবসা লেবাননের একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেশটি ত্যাগ করে।

মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস দেশটির তেল গ্যাস। তাদের রাজস্ব আয়ের অর্ধেক আসে এই খাত থেকে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা দেশটির তেল-গ্যাস ফান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার দাবি তুলেছিল; কিন্তু পশ্চিমা কোম্পানিগুলো তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়তো চাইলে মিয়ানমারের উপর বাণিজ্যিক অবরোধ দিতে পারে। কিন্তু সেটা তারা দিচ্ছে না।

‘আমার ধারণা এই পদক্ষেপ যে তারা দিচ্ছে না, তার প্রধান কারণ— বাণিজ্যিক অবরোধ দেওয়া হলে ইউরোপের সাধারণ মানুষ বেকায়দায় পড়বে,’ বিবিসিকে বলেন হুমায়ুন কবির।

সূত্র: বিবিসি

এসএমডব্লিউ