কুশিয়ারা নদীর পানি চুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ভারতে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষ করে গত সপ্তাহে দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই সফরের সময় উভয় পক্ষই বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এসব চুক্তির মধ্যে একটি নদীর পনি বণ্টন চুক্তিও রয়েছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তির পর এ ধরনের চুক্তি এটিই প্রথম। মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বরাক নদীর শাখা কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়।
বিজ্ঞাপন
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তিটি এমন এক বছরে স্বাক্ষরিত হলো যখন ভারতের আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে প্রাণঘাতী বন্যা হয়েছে। ভয়াবহ এই বন্যা দুই দেশের মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচ সংক্রান্ত বিষয়ে বৃহত্তর সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তাও সামনে এনেছে।
কুশিয়ারা চুক্তি কি?
গত শতাব্দীজুড়ে বরাক নদীর পানি প্রবাহ এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে যে, নদীর পানির সিংহভাগ আসে কুশিয়ারায় এবং বাকি অংশ যায় সুরমায়। পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের মতে, নদীর পরিবর্তনের প্রকৃতি বাংলাদেশের সামনে যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার একটি অংশকে সমাধান করার লক্ষ্যে চুক্তিটি করা হয়েছে।
কারণ বর্ষাকালে বন্যা হয় এবং শীতকালে সিলেটে ফসল ফলানোর মৌসুমে পানির চাহিদা বেড়ে গেলে এই নদী শুকিয়ে যায়। যদিও চুক্তির বিশদ বিবরণ এখনও জানা যায়নি, তবে ড. নিশাত বলেছেন, এই সমঝোতা স্মারকের অধীনে বাংলাদেশ কুশিয়ারা থেকে শীত মৌসুমে নদীতে থাকা প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিউসেক পানির মধ্যে ১৫৩ কিউসেক (প্রতি সেকেন্ডে ঘনফুট) পানি প্রত্যাহার করতে পারবে।
চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক (ঘনফুট প্রতি সেকেন্ড) পানি প্রত্যাহার করতে পারবে যা সিলেটের কৃষকদের পানি সংকট দূর করবে। এর ফলে এই পানি সরবরাহ থেকে সিলেট অঞ্চলের অনেক এলাকা উপকৃত হবে। তবে সাধারণভাবে যা বোঝা যায় তাতে, আনুমানিক ১০ হাজার হেক্টর জমি এবং লক্ষাধিক মানুষ এতে উপকৃত হবেন।
মূলত বাংলাদেশের প্রত্যাহার করা পানি সিলেটের খাল নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবে এবং বোরো ধান চাষের সাথে জড়িত কৃষকরা উপকৃত হবেন। এই ধান মূলত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির শুষ্ক মৌসুমে চাষ করা হয়ে থাকে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে কাটা হয়।
ভারত কুশিয়ারা থেকে প্রয়োজনীয় পানি প্রত্যাহারের অনুমতি না দেওয়ায় এ অঞ্চলে বোরো ধানের চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছিল বাংলাদেশ। চুক্তিটি শীত মৌসুমের মাসগুলোতে নদীর পানি সরবরাহ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগেরও সমাধান করবে। তবে কুশিয়ারার অববাহিকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণে আরও অনেক কাজ করার রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পানি কিভাবে ব্যবহার করবে?
কুশিয়ারার পানি সিলেটের রহিমপুর খাল প্রকল্পের মাধ্যমে প্রবাহিত হবে। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর খাল প্রকল্পটি কৃষকদের কুশিয়ারার পানি পেতে সহায়তা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু যে সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল তা পূরণ না করে শীত মৌসুমে এটি শুষ্কই থাকত।
আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি কুশিয়ারা নদী থেকে এই অঞ্চলে পানির একমাত্র সরবরাহকারী। আর তাই বাংলাদেশ পানি প্রত্যাহারের জন্য একটি পাম্প হাউস এবং অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি করেছে যা এখন ব্যবহার করা যেতে পারে।
রহিমপুর খালের জন্য কুশিয়ারার পানি এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন?
সিলেটের জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার এলাকায় কয়েক শতাব্দী ধরে কুশিয়ারার পানি ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে খালে পানির প্রবাহ ও পরিমাণ কমে গেছে বলে দেখতে পারছে বাংলাদেশ।
মূলত শুষ্ক মৌসুম/শীতকালে নদী ও খালের উপযোগিতা কমে যাওয়ার ফলে ধানের পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির চাষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই রহিমপুর খালের মাধ্যমে কুশিয়ারার অতিরিক্ত পানিই সিলেটের কৃষিক্ষেত্র ও বাগানে সেচের জন্য পানির স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়।
রহিমপুর খাল নিয়ে ভারতের আপত্তি কী ছিল?
গত ২৫ আগস্ট যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের সময় কুশিয়ারা পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় স্বাক্ষরিত হয়। মূলত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের সময় ভারত রহিমপুর খালের মাধ্যমে বাংলাদেশের কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারে বিষয়ে তার আগের যে আপত্তি ছিল তা প্রত্যাহার করে নেয়।
ভারতের আপত্তি প্রত্যাহার সম্ভবত এই চুক্তির প্রধান অংশ বলে জানাচ্ছেন ড. নিশাত।
এর আগে, এই অঞ্চলে আপার সুরমা কুশিয়ারা প্রকল্প পরিচালনা করেছিল বাংলাদেশ। এই প্রকল্পের মধ্যে খাল এবং অন্যান্য সংযুক্ত পানির চ্যানেলগুলো পরিষ্কার ও ড্রেজিংয়ের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল; কিন্তু সেসব চ্যানেল বাংলাদেশের জন্য খুব একটা কাজে আসেনি কারণ ভারত এই পদক্ষেপে আপত্তি জানিয়ে আসছিল।
ভারতের দাবি ছিল, বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য নির্মিত দীর্ঘ প্রাচীর বা বাঁধ অথবা জলধারা এবং অন্যান্য অবকাঠামো সীমান্ত নিরাপত্তায় হস্তক্ষেপ করেছে। কারণ কুশিয়ারা নদী দুই দেশের সীমান্তের অংশ।
তবে এসব কিছুর পরও এই চুক্তিটি এটিই সামনে এনেছে যে, নদী থেকে সম্ভাব্য যেসব অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে তা (ভারতের) নিরাপত্তা উদ্বেগের চেয়ে বেশি। সিলেটের উর্বর সমতলভূমি সবজি উৎপাদনের জন্য পরিচিত, যার ভারতের ঠিক পার্শ্ববর্তী সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং বিদেশেও প্রচুর বাজার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিস্তা চুক্তিতে বাধা কী?
কুশিয়ারা চুক্তি তিস্তার তুলনায় তুলনামূলকভাবে ছোট এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট। মূলত তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে যে প্রস্তাবনা রয়েছে তাতেই সমস্যা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের।
অপরদিকে কুশিয়ারা চুক্তির জন্য আসামের মতো কোনো রাজ্যের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল না। যদিও বরাক নদী আসামে সৃষ্টির পর রাজ্যটির ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে এবং (বাংলাদেশে) কুশিয়ারা ও সুরমা এই নদীরই শাখা-প্রশাখা।
শীতকালে তিস্তা ও কুশিয়ারায় কম পানি প্রবাহ অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছে। এই ধরনের সমস্যা বহু মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং অভিবাসনকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
এছাড়া শীতের মাসগুলোতে নিজের নদীগুলোতে কম পানিপ্রবাহকে উদ্বেগের বিষয় হিসাবে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ। কারণ পানিপ্রবাহ কম হলে তা বাংলাদেশের কৃষি খাতকেই কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত করে।
টিএম