সালমান রুশদি কে, মুসলমানরা ক্ষুব্ধ কেন?
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি লেখালেখির বিশেষ ঢংয়ের কারণে গত পাঁচ দশকের সাহিত্যিক জীবনে হত্যার হুমকি প্রায়ই পেয়েছেন। ব্রিটেনের সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সফল ব্রিটিশ লেখকদের একজন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাদু বাস্তবতায় লেখা নিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’র জন্য ১৯৮১ সালে বুকার পুরস্কার পান তিনি।
কিন্তু নিজের চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ ১৯৮৮ সালে প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন তিনি। তার সাহিত্যিক জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত এই উপন্যাসের জেরে নজিরবিহীন আন্তর্জাতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় সেই সময়।
বিজ্ঞাপন
ইসলামী বিশ্বের অনেক মুসলমান বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চিত্রায়ন করা তাদের বিশ্বাসের প্রতি গুরুতর আঘাত। এই উপন্যাস লিখে মৃত্যুর হুমকি পান ৭৫ বছর বয়সী রুশদি। যা তাকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করে এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে বিশেষ পুলিশি সুরক্ষা দেয়।
রুশদির দ্য স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাজ্যের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ইরান। বইটি প্রকাশের এক বছর পর ১৯৮৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি এই ঔপন্যাসিকের বিরুদ্ধে মৃত্যুর ফতোয়া জারি করেন।
বই প্রকাশের ঘটনায় মুসলিম বিশ্বের এমন সহিংস প্রতিক্রিয়াকে পশ্চিমা লেখক এবং বুদ্ধিজীবীরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকি বলে নিন্দা জানান।
জন্ম, বেড়ে ওঠা আর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ
সালমান রুশদির জন্ম ভারতের বোম্বেতে- যা বর্তমানে মুম্বাই হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের দুই মাস আগে মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৪ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যে যান এবং সেখানকার রাগবি শহরের একটি স্কুলে ভর্তি হন। পরে কেমব্রিজের মর্যাদাপূর্ণ কিংস কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পান রুশদি। পরে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। উপন্যাস লেখার সময় কিছুদিনের জন্য অভিনয়ও করেন। তারপর বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার হিসেবে কাজ করেন তিনি। তার প্রথম প্রকাশিত বই ‘গ্রিমাস’ তেমন সফল হয়নি। তবে গ্রিমার্সের সুবাদে সাহিত্যের কিছু সমালোচক তাকে ‘সম্ভাবনাময় লেখক’ হিসাবে দেখতে শুরু করেন।
রুশদি দ্বিতীয় বই ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ লেখার জন্য পাঁচ বছর সময় নেন; যা তাকে ১৯৮১ সালে সাহিত্যের সম্মানজনক পুরস্কার বুকার এনে দেয়। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং কিছুদিনের মধ্যেই বইটির পাঁচ লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাদু বাস্তবতায় মিডনাইটস চিলড্রেন’ লিখেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের ছদ্মবেশ নিয়ে রুশদির তৃতীয় উপন্যাস ‘শেইম’ ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। এর চার বছর পর নিকারাগুয়া সফরের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘দ্য জাগুয়ার স্মাইল’ লেখেন তিনি।
দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার কবলে রুশদির বই
১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে রুশদির জীবনকে বিপন্ন করে তোলা ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হয়। জাদুবাস্তবতা ও উত্তরাধুনিক এই উপন্যাস কিছু মুসলমানের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করে; যারা এই বইয়ের বিষয়বস্তুকে ধর্ম অবমাননাকর বলে মনে করেন।
ভারতই প্রথম রুশদির এই বই নিষিদ্ধ করে। পাকিস্তানেও বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। পরে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশই সালমান রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ করে। উপন্যাসটি অনেক মহলে প্রশংসিত হয় এবং এটির জন্য হুইটব্রেড পুরস্কার পান তিনি। কিন্তু বইটির বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি পায় এবং দুই মাস পরে এই প্রতিক্রিয়া রাস্তায় বিক্ষোভে রূপ নেয়।
মুসলমানদের কেউ কেউ সালমান রুশদির এই উপন্যাসকে ইসলামের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন। তারা এই বইয়ের দুটি নারী চরিত্র নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলেন। ওই দুই চরিত্রে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দুজন স্ত্রীকেও জড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ডের মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে বইটির একটি কপি আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। একইসঙ্গে সংবাদদাতা ডব্লিউএইচ স্মিথের আয়োজিত এক প্রদর্শনী থেকে বইটি নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়। তবে রুশদি ধর্ম অবমাননার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পরে রুশদির নিজ শহর মুম্বাইয়ে মুসলমানদের দাঙ্গায় অন্তত ১২ জন নিহত হন। ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত ব্রিটিশ দূতাবাসে পাথর নিক্ষেপের পাশাপাশি এই লেখকের মাথার দাম ৩০ লাখ ডলার ঘোষণা করা হয়।
এদিকে, যুক্তরাজ্যের কিছু মুসলিম নেতা মধ্যপন্থার আহ্বান জানালেও অন্যান্যরা আয়াতোল্লাহকে সমর্থন করেন। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো রুশদিকে হত্যার হুমকির নিন্দা জানায়। আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্ত্রীকে নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের বিশেষ সুরক্ষা পেতেন তিনি। বইটি ঘিরে মুসলমানদের ভোগান্তি তৈরি হওয়ায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু তারপরও আয়াতোল্লাহ খোমেনি এই ঔপন্যাসিকের হত্যার হুমকি পুনর্ব্যক্ত করেন।
দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের প্রকাশক ভাইকিং পেঙ্গুইনের লন্ডন কার্যালয় তছনছ করা হয় এবং নিউইয়র্কের কার্যালয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
রুশদির বইয়ের অনুবাদকদের হত্যা, খুনি অজানা
এমন পরিস্থিতিতেও বইটি আটলান্টিকের উভয় তীরে সর্বোচ্চ বিক্রিত হয়ে ওঠে। মুসলিমদের উগ্র প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সমর্থন জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো। পরে ইইউর সব দেশ সাময়িকভাবে তেহরান থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়।
তবে বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে কেবল এই লেখকই একাই হুমকি পাননি। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে টোকিওর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’র জাপানি অনুবাদক খুন হন। সেই সময় পুলিশ জানায়, অনুবাদক হিতোশি ইগারাশি আপেক্ষিক সংস্কৃতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করতেন। তাকে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত এবং সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অফিসের বাইরে ফেলে রাখা হয়। তার খুনিকে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একই মাসের শুরুতে বইটির ইতালীয় অনুবাদক ইত্তোরে ক্যাপ্রিওলোকে মিলানে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ছুরিকাঘাত করা হয়। যদিও তিনি সেই হামলায় প্রাণে বেঁচে গেছেন। বইটির নরওয়েজীয় অনুবাদক উইলিয়াম নাইগার্ডকে ১৯৯৩ সালে অসলোতে তার বাড়ির বাইরে গুলি করা হয়; তিনিও বেঁচে যান।
রুশদির বই
রুশদির অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশুদের জন্য লেখা উপন্যাস হারুন অ্যান্ড দ্য সি অব স্টোরিজ (১৯৯০), প্রবন্ধের বই ইমাজিনারি হোমল্যান্ডস (১৯৯১) এবং উপন্যাস ইস্ট, ওয়েস্ট (১৯৯৪), দ্য মুরস লাস্ট সিগ (১৯৯৫), দ্য গ্রাউন্ড বেনিথ হার ফিট (১৯৯৯) ও ফিউরি (২০০১)।
তিনি মিডনাইটস চিলড্রেন উপন্যাসের মঞ্চায়নের সাথেও জড়িত ছিলেন; যা ২০০৩ সালে লন্ডনে প্রিমিয়ার হয়। গত দুই দশকে তিনি শালিমার দ্য ক্লাউন, দ্য এনচ্যাট্রেস অব ফ্লোরেন্স, টু ইয়ারস এইট মান্থ অ্যান্ড টুয়েন্টি-এইট নাইটস, দ্য গোল্ডেন হাউস এবং কুইচোত্তি প্রকাশ করেন।
ব্যক্তিগত জীবন
ব্যক্তিগত জীবনে রুশদি চারবার বিয়ে করেছেন এবং তার দুই সন্তান রয়েছে। ব্রিটিশ নাগরিক হলেও তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০০৭ সালে ব্রিটিশ রানি তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
দ্য স্যাটানিক ভার্সেস নিয়ে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে এটি নিয়ে নিজের স্মৃতিকথা সম্বলিত একটি বই প্রকাশ করেন। ১৯৯৮ সালে রুশদির বিরুদ্ধে হত্যার হুমকির ঘোষণায় সমর্থন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে নেয় ইরানের সরকার। গত কয়েক বছরে তিনি কিছুটা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে শুরু করেন।
কিন্তু মৃত্যুর হুমকি সবসময় তার পেছনে তাড়া করে ফিরেছে। ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একবার বলেছিলেন, রুশদির বিরুদ্ধে যে ফতোয়া জারি করা হয়েছে, তা বন্দুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া বুলেটের মতো। এই বুলেট লক্ষ্যে আঘাত না হানা পর্যন্ত স্থির হবে না।
বিবিসি অবলম্বনে...
এসএস