চীনের সামরিক হুমকি উপেক্ষা করে তাইওয়ান সফরে গিয়েছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। আর এরপরই তৃতীয় শীর্ষ মার্কিন এই রাজনীতিকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল বেইজিং।

একইসঙ্গে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল পেলোসির পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও। তবে চীনের এই পদক্ষেপ হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন ন্যান্সি পেলোসি। এমনকি বেইজিংয়ের এই নিষেধাজ্ঞা কেউ মানে কি না সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেলোসির সফরের জেরে তাইওয়ানের চারপাশে চীনের সামরিক মহড়া এবং এর ফলে সৃষ্ট চাপকে ‘নিউ নরমাল’ বা স্বাভাবিক অবস্থায় পরিণত হতে দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।

সাম্প্রতিক এশিয়া সফরের সময় সঙ্গে থাকা আরও চারজন ডেমোক্র্যাটিক হাউস সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে ন্যান্সি পেলোসি বলেন, ‘আমরা যা দেখেছি তা হলো- (তাইওয়ানের চারপাশে) একটি নতুন স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে চীন। এবং আমরা এটি হতে দিতে পারি না।’

স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফরের পর গত সপ্তাহ থেকে তাইওয়ানের কাছাকাছি এলাকায় নৌ ও বিমান বাহিনীর নজিরবিহীন মহড়া চালায় চীনা সামরিক বাহিনী। বুধবার এই মহড়ার সমাপ্তি ঘোষণা করে বেইজিং। তবে কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং কূটনীতিকরা আশঙ্কা করেছিলেন, মহড়ার মাধ্যমে হয়তো তাইওয়ানের প্রতিরক্ষার ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে বেইজিং।

চীন বুধবার বলেছে, তারা তাইওয়ানের আশপাশে ‘বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছে’। তবে ওই অঞ্চলে তাদের নিয়মিত টহল অব্যাহত রাখবে।

অবশ্য নিজের তাইওয়ান সফর যে ন্যায়সঙ্গত ছিল সে সম্পর্কে এখনও বেশ সরব ন্যান্সি পেলোসি। বুধবার ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা সেখানে তাইওয়ানের প্রশংসা করতে গিয়েছিলাম। আমরা সেখানে গিয়েছিলাম আমাদের বন্ধুত্ব প্রদর্শন করতে। চীন (কখনোই) তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।’

তবে সফরের জেরে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চীনের নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হেসেই উড়িয়ে দেন পেলোসি। পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘(চীনের এই নিষেধাজ্ঞা) কে মানে?’

পেলোসি আরও বলেন, ‘এটি আমার কাছে ঘটনাগত, কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়।’

এর আগে গত শুক্রবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া একটি বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক তাইওয়ান সফরের মাধ্যমে ন্যান্সি পেলোসি চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে গুরুতরভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন এবং চীনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখণ্ডতাকে অবমূল্যায়ন করেছেন।’

‘এ কারণে পেলোসি ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধজ্ঞা জারি করছে চীনের সরকার। যতদিন এ নিষেধাজ্ঞা থাকবে, ততদিন তিনি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য এ দেশে প্রবেশ করতে পারবেন না।’

মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এর বেশি আর কিছু বলা হয়নি।

উল্লেখ্য, তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে। তাইওয়ান পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ, যা তাইওয়ান প্রণালীর পূর্বে চীনা মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। অবশ্য তাইওয়ানকে বরাবরই নিজেদের একটি প্রদেশ বলে মনে করে থাকে বেইজিং।

গত বছরের অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, মূল ভূখণ্ডের সাথে তাইওয়ানের পুনরেকত্রীকরণ অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। এজন্য সামরিক পথে অগ্রসর হওয়ার বিষয়টিও খোলা রেখেছে বেইজিং।

অন্যদিকে চীনের প্রদেশ নয়, বরং নিজেকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে মনে করে থাকে তাইওয়ান। চীনা প্রেসিডেন্টের এমন মন্তব্যের জবাবে সেসময় তাইওয়ান জানায়, দেশের ভবিষ্যৎ তার জনগণের হাতেই থাকবে।

তবে তাইওয়ানকে চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে বেইজিংয়ের চেষ্টার কমতি নেই। তাইওয়ান উপত্যাকার চারদিকে সামরিক কর্মকাণ্ড জোরদার করেছে চীন। এমনকি গত বছরের মতো চলতি বছরের শুরু থেকেই তাইওয়ানের এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন (এডিআইজেড) লঙ্ঘন করে আসছে বৈশ্বিক এই পরাশক্তি দেশটি।

তবে এরইমধ্যে গত সপ্তাহে রাতের আঁধারে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপে পৌঁছান ন্যান্সি পেলাসি। ১৯৯৭ সালের পর এটি কোনো মার্কিন শীর্ষ রাজনীতিকের তাইওয়ান সফর। এই সফরকে কেন্দ্র করে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে।

দফায় দফায় হুঁশিয়ারি দেওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের এই স্পিকারের তাইওয়ান সফরকে মোটেই সহজভাবে নেয়নি চীন। আর তাই ন্যান্সির সফরের প্রতিক্রিয়ায় রাতেই তাইওয়ানে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেয় চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করার পর তাইওয়ান দেশটির মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও তাইওয়ানকে বরাবরই নিজেদের একটি প্রদেশ বলে মনে করে থাকে বেইজিং। এরপর থেকে তাইওয়ান নিজস্ব সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে।

টিএম