ইসরায়েলকে বর্ণবাদী রাষ্ট্র ঘোষণার দাবি দক্ষিণ আফ্রিকার
ইসরায়েলকে বর্ণবাদী রাষ্ট্র ঘোষণার দাবি জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এছাড়া ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের উল্লেখযোগ্য অংশ ক্রমাগত দখল করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আফ্রিকার এই দেশটির সরকার।
একইসঙ্গে পশ্চিম তীর ভূখণ্ডে নতুন বসতি গড়ে তোলা ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের উজ্জ্বল উদাহরণ’ হিসাবেও উল্লেখ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। বুধবার (২৭ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী প্রিটোরিয়ায় অনুষ্ঠিত আফ্রিকায় ফিলিস্তিনি মিশন প্রধানদের দ্বিতীয় বৈঠকে দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা মন্ত্রী নালেদি পান্ডর ইসরায়েলকে বর্ণবাদী রাষ্ট্র ঘোষণার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নিপীড়ন ও নির্যাতনের নিজস্ব ইতিহাসের অভিজ্ঞতার মিল রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিপীড়িত দক্ষিণ আফ্রিকান হিসাবে, আমরা জাতিগত বৈষম্য, নিপীড়ন ও বঞ্চনার প্রভাবগুলো নিজেরাই অনুভব করেছি এবং ফিলিস্তিনিদের আরেকটি প্রজন্ম এখন সেই পরিস্থিতিতে থাকলেও আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারছি না।’
পান্ডর বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বাস করে, ইসরায়েলকে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা উচিত এবং দেশটি (জাতিসংঘের সদস্য থাকার মতো) প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করে কি না তা যাচাই করার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (ইউএনজিএ)-এর একটি কমিটি গঠন করা উচিত।
এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ফোরামে যোগ দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ মালকি। মঙ্গলবারের অধিবেশনের পর রাষ্ট্র পরিচালিত দক্ষিণ আফ্রিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (এসএবিসি) সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
সেখানে মালকি বলেন, ‘যদি বিশ্বে এমন কোনো দেশ বা (একাধিক) দেশ থেকে থাকে যারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম এবং দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারে, তাহলে সেসব দেশ হলো আফ্রিকা মহাদেশের এবং আফ্রিকার জনগণ।’
এর আগে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি নীতি বর্ণবাদী বলে জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন এক রিপোর্ট সংস্থাটি জানায়, ইসরায়েলের ভেতর এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ইসরায়েলের নীতি, আইন, আচরণ ‘আ্যাপারথাইড’ অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের সমতুল্য।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, ইসরায়েল এমন একটি নির্যাতনমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে যা প্রয়োগ করে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর কর্তৃত্ব ফলানো যায়।
ওই রিপোর্টে বলা হয়, ‘ইসরায়েলের ইহুদিদের স্বার্থে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য বজায় রাখতে ইসরায়েল রাষ্ট্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে।’
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের ‘অ্যাপারথাইড’ অর্থাৎ নির্যাতন এবং বৈষম্যমূলক আইনের মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীর ওপর অন্য জনগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।
অ্যাপারথাইড কি?
দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকরা ১৯৪৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে পৃথক রাখতে, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করতে যে কুখ্যাত নীতি নিয়েছিল তা অ্যাপারথাইড নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের ন্যাশনাল পার্টি সরকার এই নীতি জারি করে যাতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের নিকৃষ্ট জাতিগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা শুরু হয়।
সেসময় জাতীয় নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের অধিকার খর্ব করা হয়। শ্বেতাঙ্গ এলাকায় প্রবেশ বা বসবাস নিষিদ্ধসহ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিকাংশ জায়গায় কৃষ্ণাঙ্গদের জমির মালিকানা নিষিদ্ধ হয়। লোভনীয় এবং দক্ষ সমস্ত চাকরি শ্বেতাঙ্গদের জন্য রিজার্ভ রাখা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে নির্বাচনে জেতার পর ওই আইন বাতিল করা হয়।
তিনটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করে অ্যাপারথাইডকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে, ১৯৭৩ সালের একটি কনভেনশন অ্যাপারথাইডের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এমন : ‘একটি জাতিগোষ্ঠীর ওপর অন্য এক জাতিগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তা বজায় রাখতে যে অমানবিক কর্মকাণ্ড এবং সুপরিকল্পিত নির্যাতন চালানো হয়।’
টিএম