মাঙ্কিপক্স নিয়ে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করল ডব্লিউএইচও
ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের কারণে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় শনিবার জাতিসংঘের স্বাস্থ্য বিষয়ক এই সংস্থা জরুরি সতর্কতা জারি করেছে।
এর আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ১১ মার্চ করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস নিয়ে ডব্লিউএইচওর জরুরি কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সতর্কতা জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে খবর দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৫টিরও বেশি দেশে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
ভাইরাল সংক্রমণজনিত এই রোগটি পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকায় সাধারণত সবচেয়ে বেশি দেখা গেলেও চলতি বছর সেই গণ্ডি পেরিয়েছে। গত ৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। নাইজেরিয়া থেকে ওই ব্যক্তি ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন: মাঙ্কিপক্স কতটা প্রাণঘাতী?
গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স প্রাদুর্ভাবে অন্তত ৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিবিসি বলছে, বিশ্বজুড়ে বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারি এবং পোলিও নির্মূলের অব্যাহত প্রচেষ্টা নিয়ে এ ধরনের দুটি জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা হিসাবে তালিকাভুক্ত করা উচিত কি-না সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি ডব্লিউএইচওর জরুরি কমিটি। তবে তিনি বলেছেন, বিশ্বজুড়ে এই প্রাদুর্ভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে; যে কারণে তিনি এটাকে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয় হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
টেড্রোস বলেছেন, সংক্রমণের নতুন গতি সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেছেন, ডব্লিউএইচওর মূল্যায়নে ইউরোপীয় অঞ্চল মাঙ্কিপক্সের ‘উচ্চ’ ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউরোপ ছাড়া বিশ্বের সব অঞ্চলে মাঙ্কিপক্সের ঝুঁকি ‘মাঝারি’ মাত্রার বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডব্লিউএইচওর এই মহাপরিচালক বলেছেন, এই ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে আরও ছড়িয়ে পড়ার ‘স্পষ্ট ঝুঁকি’ রয়েছে। তবে বিশ্বজুড়ে মানুষের ভ্রমণে হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা এই মুহূর্তে কম।
আরও পড়ুন: মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তদের অধিকাংশই সমকামী পুুরুষ: ডব্লিউএইচও
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই ঘোষণা মাঙ্কিপক্সের টিকা তৈরির গতি ত্বরান্বিত এবং ভাইরাসের বিস্তার সীমিত করার ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ এবং সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে বিশ্বের সরকারগুলোকে ডব্লিউএইচওর সতর্কতা উদ্বুদ্ধ করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন টেড্রোস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রধান বলেছেন, মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে থামানো যেতে পারে।
মাঙ্কিপক্স কতটা বিপজ্জনক?
মার্কিন একজন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, এই সময়ে সাধারণ জনগণের জন্য মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের ঝুঁকি কম। মাঙ্কিপক্স একটি বিরল ও স্বল্প পরিচিত রোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ ও আদ্র বনাঞ্চলের বানররা ছিল এ রোগের প্রথম শিকার। তারপর একসময় মানবদেহেও সংক্রমিত হওয়া শুরু করে রোগটি।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাসজনিত অসুখ। স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণির একটি ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। ভাইরাসটির দু’টি রূপান্তরিত ধরন রয়েছে— মধ্য আফ্রিকান ও পশ্চিম আফ্রিকান।
রোগটির বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। প্রথম পর্যায়ে রোগীর জ্বর আসে, পাশাপাশি শরীরে দেখা দেয় ফোস্কা ও অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি ওঠে। পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে।
মার্কিন ওই কর্মকর্তা বলেছেন, এই ভাইরাল সংক্রমণের সাথে গুটিবসন্তের সম্পর্ক আছে। তবে সংক্রমণ সাধারণত মৃদু হয়। বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকান ভাইরাসের প্রজাতিটি মৃদু ধরনের; যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সনাক্ত হয়েছে। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার প্রায় ১ শতাংশ। বেশিরভাগ মানুষ দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন: মাঙ্কিপক্সের ৯৫ শতাংশ সংক্রমণ ছড়িয়েছে যৌনতার মাধ্যমে: গবেষণা
১৯৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকার ১১ দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের পর নাইজেরিয়ায় এবার সবচেয়ে বেশি এ রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। দেশটিতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের দেহে উপসর্গ দেখা গেলেও ১৫ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, সক্রিয় ফুসকুড়ি আছে এমন ব্যক্তির ত্বকের সাথে অন্য কারও ত্বকের সংস্পর্শের মাধ্যমে বর্তমানে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ছে। একবার কারও সংক্রমণ শনাক্ত হয়ে গেলে তা যাতে অন্যদের শরীরে না ছড়ায় সেজন্য এর বিস্তারের লাগাম টানতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক মার্টিন হির্সচ রয়টার্সকে বলেছেন, কোভিড-১৯ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি অত্যন্ত সংক্রামক। কিন্তু মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে এমন ঘটবে না বলে মনে হচ্ছে।
বর্তমানে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হওয়া লোকজনের মাঝে— এমন অনেক পুরুষ আছেন, যারা পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করেছেন। স্পেনের মাদ্রিদ অঞ্চলের সাউনার কয়েকটি ঘটনায় এ ধরনের শারীরিক সম্পর্কের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায়?
মাঙ্কিপক্স রোগের জন্য এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তবে ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন, সেই স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া শুরু করেছে যুক্তরাজ্য।
আরও পড়ুন: মানবদেহে বিরল ‘মাঙ্কিপক্স’ ভাইরাসের সন্ধান, কী এই রোগ
মার্কিন সরকার বলেছে, পুরো দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য স্ট্র্যাটেজিক ন্যাশনাল স্টকপাইলে (এসএনএস) গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনের যথেষ্ট মজুত আছে। এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, গুটিবসন্তের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রয়েছে; যা বিশেষ পরিস্থিতিতে মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, আরও বিশদভাবে বলা যায়— এমন কারও সাথে লোকজনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক এড়িয়ে চলা উচিত, যার শরীরে ফুসকুড়ি রয়েছে অথবা অন্য কোনও অসুস্থতায় ভুগছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন বলে যাদের সন্দেহ রয়েছে, তাদের আইসোলেশনে যাওয়া এবং চিকিৎসা সেবা নেওয়া উচিত।
এসএস