ভারতের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন দেশটির ক্ষমতাসীন এনডিএ জোটের প্রার্থী আদিবাসী সাঁওতাল নারী দ্রৌপদী মুর্মু। তিনিই দেশটির প্রথম কোনও আদিবাসী নারী, যিনি রাইসিনা হিলসের মসনদে বসলেন ৫০ শতাংশের বেশি ভোটমূল্য পেয়ে।

ভারতের নবনির্বাচিত আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন ২০১৭ সালে। ওই সময় ওড়িশার এই আদিবাসী নারীকে দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

দ্রৌপদী মুর্মুর জন্ম ১৯৫৮ সালে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বাইদাপোসি গ্রামে। ভারতের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী গোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্য তিনি। একজন গ্রাম পরিষদ প্রধানের কন্যা মুর্মু রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরের রামাদেবী মহিলা কলেজে পড়াশোনা করেন।

১৯৮০ সাল থেকে তাকে চেনেন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী নিগমানন্দ পট্টনায়েক। তিনি বলেন, মুর্মু তার গ্রামের স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন।

‘সে যখন শিশু ছিল তখন ওড়িশা সরকারের মন্ত্রী কার্তিক মাঝি পাশের শহর রায়রাংপুরে এক সমাবেশে আসেন। তখন সমাবেশে মেয়েকে নিয়ে যান মুর্মুর বাবা। হঠাৎ সে দৌড়ে মঞ্চে উঠে তার স্কুল সার্টিফিকেট নেড়ে মন্ত্রীকে বলল যে, সে ভুবনেশ্বরে পড়তে চায়।’

‘মন্ত্রী ছোট্ট মেয়েটির প্রবল উৎসাহ দেখে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি রাজ্যের রাজধানীর একটি সরকারি স্কুলে তার ভর্তিতে সহায়তা করার জন্য দলের কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন,’ বলেন পট্টনায়েক।

পরে ওড়িশা সরকারের একজন কেরানি হিসাবে কর্মজীবন শুরু হয় মুর্মুর। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সেখানকার সেচ ও জ্বালানি বিভাগের জুনিয়র সহকারী হিসাবে কাজ করেন তিনি। শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে ভুবনেশ্বরে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর পরিবারের দেখভালের জন্য রায়রাংপুরে ফিরে আসেন দ্রৌপদী। পরে শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন তিনি।

পট্টনায়েক বলেন, ‘কিন্তু তিনি বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানান। তখন স্কুল থেকে শুধু তাকে রিকশা ভাড়া দেওয়া হয়। সেই সময় দ্রৌপদী বলেছিলেন, ‘এটা চাকরি নয়, জনসেবা। আমার স্বামী একজন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং তার বেতনই পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট।’

দ্রৌপদীর রাজনীতিতে পথচলা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। ওই বছর তিনি রায়রাংপুরের স্থানীয় নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাকে প্রায়ই ড্রেন পরিষ্কার থেকে শুরু করে আবর্জনা অপসারণের সময়ও রোদে দাঁড়িয়ে শহরের স্যানিটেশন কাজের তত্ত্বাবধান করতে দেখা যায়।

বিজেপির সদস্য হিসাবে তিনি রায়রাংপুর আসনে দু’বার বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন— ২০০০ এবং ২০০৯ সালে। ২০০০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিজু জনতা দল পার্টির নবীন পট্টনায়কের নেতৃত্বে রাজ্যের জোট সরকারের মন্ত্রী হন। প্রাথমিকভাবে বাণিজ্য ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দফতর সামলান তিনি। পরে রাজ্যের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রীও হন তিনি।

২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ‘তফসিলি উপজাতির’ বিজেপির রাজ্য শাখার সভাপতি ছিলেন মুর্মু। ভারতের সংবিধানে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায় হিসেবে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর স্বীকৃতি রয়েছে। ২০০৯ সালে দুঃখজনক মোড় নেয় দ্রৌপদীর জীবন; রহস্যজনক এক পরিস্থিতিতে বড় ছেলেকে হারিয়ে ফেলেন তিনি। এর কয়েক বছর পর দ্বিতীয় ছেলে এবং স্বামীকেও হারান তিনি।

ওড়িশার বিজেপির নেতা কবি বিষ্ণু সতপতী বলেন, ‘এবার একেবারে ভেঙে পড়েন মুর্মু। যখনই আমরা দেখা করতাম তখনই তিনি অসহায়ভাবে কান্না করতেন। তিনি বলতেন, আমার জীবনে আর কিছুই থাকল না।’

নিজেকে সামলে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেন মুর্মু। ২০১৫ সালে প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের প্রথম নারী গভর্নর নিযুক্ত হন তিনি। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ছয় বছর এই পদে আসীন ছিলেন তিনি। বিবিসি হিন্দির রবি প্রকাশের মতে, মুর্মু তার মেয়াদে রাজ্যপালের কার্যালয়কে সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত রেখে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।

বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি প্রটোকল ভেঙে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যান। যেমন, তিনি ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েককে তার বাড়িতে দেখতে যান একাই। এমনকি একটি প্রতিনিধি দলকে নিয়ে বাসভবনে গিয়ে রেলমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। এ সময় তার নিজ জেলা ময়ূরভঞ্জে রেল পরিষেবা সম্প্রসারণের জন্য মন্ত্রীকে চাপ দেন।

মুর্মুর রাজনৈতিক পরামর্শক রাজকিশোর দাস বলেন, ‘দুটি ঘটনাই প্রটোকলের লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনও পাত্তাই দেননি।’

সূত্র: বিবিসি।

এসএস