ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন বরিস জনসন। নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির মন্ত্রী ও আইনপ্রণেতাদের একের পর এক পদত্যাগের পর দেশটির সরকারে কার্যত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া জনসন বৃহস্পতিবার এই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে পদত্যাগের ঘোষণায় জনসন বলেন, ‘দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণের প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু করা উচিত। আর নতুন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই অন্তর্বর্তী সময়ে একটি নতুন মন্ত্রিসভা নিয়োগ নিয়োগ করা হবে। আজ থেকেই এই বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করব আমি।’

নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে কনজারভেটিভ পার্টিতে গত কয়েক মাস ধরে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন ব্রিটিশ এই প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে শেষ মুহূর্তে দলটির জ্যেষ্ঠ সব মন্ত্রী এবং মিত্ররা সরে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পদে টিকে থাকাটাই তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পদত্যাগের ঘোষণায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদে আর থাকতে না পারার জন্য অনুশোচনা প্রকাশও করেছেন বরিস জনসন।

জনসনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে পেরেক ঠুকে দেওয়া কয়েকটি আলোচিত কেলেঙ্কারি...

দ্য পিনচার কেলেঙ্কারি

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসনের কার্যালয় আইনপ্রণেতা ক্রিস্টোফার পিনচারের বিরুদ্ধে অতীতের যৌন হয়রানির অভিযোগ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে বলে একজন সাবেক বেসামরিক কর্মকর্তা অভিযোগ তোলেন। তার এই অভিযোগের পর বুধবার কনজারভেটিভ পার্টির সরকার থেকে গণপদত্যাগ শুরু হয়।

গত ফেব্রুয়ারিতে বরিস জনসন পিনচারকে হাউস অব কমন্সের ডেপুটি চিফ হিসেবে নিয়োগ দেন। এর মাধ্যমে কনজারভেটিভ দলীয় অন্যান্য আইনপ্রণেতাদের কল্যাণের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব পান পিনচার। কিন্তু মাতাল অবস্থায় তিনি মানুষকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছিলেন বলে গত সপ্তাহে স্বীকার করার পর পিনচারকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে পিনচার অতীতে যৌন হয়রানিতে জড়িত ছিলেন বলেও চাউর হয়।

প্রাথমিকভাবে জনসনের কার্যালয় জানায়, পিনচারের অতীতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবগত ছিলেন না। সোমবার দেশটির সাব্কে জ্যেষ্ঠ বেসামরিক কর্মকর্তা সাইমন ম্যাকডোনাল্ড একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি ২০১৯ সালে পিনচারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগের তদন্ত করেছিলেন এবং এর সত্যতা পেয়েছিলেন বলে জানান।

পার্টিগেট

ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটসহ সরকারের অন্যান্য কেলেঙ্কারি বোঝাতে দেশটিতে ‘পার্টিগেট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় দেশটিতে যখন প্রথমবারের মতো লকডাউন জারি করা হয়, সেই সময় লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে জন্মদিনের পার্টিতে যোগ দেন বরিস জনসন।

জন্মদিনের পার্টিতে অংশ নেওয়ায় পুলিশ জনসনকে জরিমানা করে এবং দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এমনকি ২০২১ সালের এপ্রিলে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্যের সময়ও ডাউনিং স্ট্রিটের কর্মচারীরা পার্টি করেছিলেন বলে নতুন তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। পরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন জনসন।

পরে ডাউনিং স্ট্রিটের জ্যেষ্ঠ একজন বেসামরিক কর্মী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একের পর এক অবৈধ লকডাউন পার্টি আয়োজন করা হয়েছিল বলে স্বীকারোক্তি দেন। শুধু তাই নয়, সেসব পার্টিতে কেউ কেউ অতিরিক্ত মদ্যপান এবং বমিও করে ফেলেন বলে জানান তিনি।

জনসন বরাবরই এসব পার্টির ব্যাপারে অবগত ছিলেন বলে দাবি করেন। তার এই দাবির ব্যাপারে দেশটির সংসদ এখনও তদন্ত করছে। জনসন বলেছেন, ডাউনিং স্ট্রিটে লোকজনের সমাবেশে আইনের লঙ্ঘন হয়নি বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। তবে সেসব ভুল ছিল বলে এখন তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।

যৌন কেলেঙ্কারি

জনসনের কনজারভেটিভ পার্টির আইনপ্রণেতাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দু’জন আইনপ্রণেতা যৌন কেলেঙ্কারির দায়ে পদত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছেন। আর এই দুই ঘটনায় সংসদের সদস্য পদ হারানো আসনে গত মাসে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনেও হেরে গেছে কনজারভেটিভরা।

১৫ বছর বয়সী এক কিশোরকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে পদত্যাগ করেন কনজারভেটিভ দলীয় আইনপ্রণেতা ইমরান আহমেদ খান। এছাড়া ‘পাগলামির এক মুহূর্তে’ হাউস অব কমন্সে নিজের ফোনে অন্তত দু’বার পর্নোগ্রাফি দেখেছেন বলে স্বীকার করার পর পদত্যাগ করেন আরেক কনজারভেটিভ দলীয় আইনপ্রণেতা নীল প্যারিশ।

আরেক কনজারভেটিভ আইনপ্রণেতাকে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এই আইনপ্রণেতাকে গত মে মাসে জামিন দেওয়া হয় এবং ভুক্তভোগীর পরিচয় জানাজানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কনজারভেটিভ দলীয় এই আইনপ্রণেতার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

ওয়েন প্যাটারসন কেলেঙ্কারি

গত বছর দেশটির সংসদের স্টান্ডার্ড কমিটি কনজারভেটিভ দলীয় আইনপ্রণেতা এবং সাবেক মন্ত্রী ওয়েন প্যাটারসনকে ৩০ দিনের জন্য সংসদ থেকে বহিষ্কার সুপারিশ করে। কিছু কোম্পানির কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তিনি তাদের পক্ষে লবিং করেছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর কমিটির ওই সুপারিশ আসে।

কনজারভেটিভরা প্রাথমিকভাবে প্যাটারসনের স্থগিতাদেশ বাতিল এবং আইনপ্রণেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রক্রিয়া সংশোধন করার জন্য সংসদে ভোট দেন। গণমাধ্যমের শিরোনামে আসার পর প্যাটারসন পদত্যাগ করেন এবং সরকার প্রস্তাবিত সংশোধনীও বাতিল করে দেয়। প্যাটারসনের আসন অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে কনজারভেটিভ দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী হেরে যান।

সংস্কার তদন্ত

বরিস জনসনের ডাউনিং স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটের সংস্কার কাজে ব্যাপক আর্থিক নয়-ছয়ের অভিযোগ ওঠে। সংস্কার কাজটির দায়িত্ব পেয়েছিলেন দেশটির একজন বিখ্যাত ডিজাইনার। ফ্ল্যাটে সোনার তৈরি ওয়ালপেপার লাগানো হয় এবং সেই বিষয়ে সঠিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় ব্রিটেনের নির্বাচন কমিশন জনসনকে ১৭ হাজার ৮০০ পাউন্ড জরিমানা করে।

পরে জনসনের নীতি-নৈতিকতা বিষয়ক উপদেষ্টা সংস্কার কাজের দাতা সংস্থার সাথে বিনিময় করা বার্তা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত জনসন ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিষয়ে মিথ্যা বলেননি বলে জানিয়ে দেন ওই উপদেষ্টা।

সূত্র: রয়টার্স।

এসএস