কোনো দেশের সরকার যখন আর্থিক সংকটের কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগ হয়, তখন দেশটি পরিচিতি পায় ‘দেউলিয়া দেশ’ হিসেবে। অনেক সময় আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে ঋণগ্রস্ত দেশটির সরকার, আবার অনেক ক্ষেত্রে সেই ঘোষণা দেওয়া হয় না।

বিশ্বজুড়ে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা শুরু হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের পর, অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। তারপর থেকে এ পর্যন্ত অতিক্রান্ত হয়েছে গত ২ শতকেরও বেশি সময়। এই সময়সীমার বিভিন্ন পর্যায়ে ইউরোপ মহাদেশের অর্ধেক দেশ, আফ্রিকা মহাদেশের ৪০ শতাংশ দেশ এবং এশিয়ার ৩০ শতাংশ দেশ বিভিন্ন সময়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।

স্বাধীন ও সার্বভৌম বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে গত ২০০ বছরে সবচেয়ে বেশিবার দেউলিয়া হয়েছে দক্ষিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডর। এই পর্যন্দ ১০ বার নিজেদের দেউলিয়া বলে ঘোষণা করেছে দেশটি।

এই তালিকায় ইকুয়েডরের পরেই আছে ব্রাজিল, মেক্সিকো, উরুগুয়ে, চিলি, কোস্টারিকা, স্পেন ও রাশিয়া। গত ২ শ’ বছরে এসব দেশ নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে ৯ বার।

এছাড়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে গত ২০০ বছরে জার্মানি ৮ বার যুক্তরাষ্ট্র ৫ বার, চীন ও যুক্তরাজ্য ৪ বার ও জাপান দু’বার নিজেদের দেউলিয়া বলে ঘোষণা করেছে।

সর্বশেষ চরম অর্থনৈতিক সংকটের কারণে চলতি বছর এপ্রিলে নিজেদের ঘোষণা করেছে ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা; কিন্তু এ বিষয়ক গত ২ যুগের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—২৪ বছরের বিভিন্ন সময়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে বিশ্বের অন্তত ৬ টি বৃহৎ দেশ। এসব দেশ হলো—

আইসল্যান্ড

২০০৮ সালে নির্মাণখাতে অতিমাত্রায় বিনিয়োগ ও এ বিষয়ক ব্যাংকঋণের প্রভাবে ধস নামে মার্কিন অর্থনীতিতে। সেই ধসের প্রভাবে যেসব দেশের অর্থনীতি গুরুতর ক্ষতির শিকার হয়, ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ড সেসবের মধ্যে অন্যতম। ২০০৮ সালে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিদেশী ঋণ রেখে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে আইসল্যান্ডের সরকার। এই পরিমাণ ‍ঋণ দেশটির তৎকালীণ জিডিপির প্রায় ১০ গুণ বেশি ছিল।

২০০৮ সালে মার্কিন অর্থনীতির মহাবিপর্যয়ের প্রভাবে আইসল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ৩টি ব্যাংক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল অর্থনৈতিক মন্দা ও পরবর্তী দুই বছরে বিধ্বস্ত অর্থনীতির মাত্র ১০ শতাংশ মেরামত করতে পেরেছিল আইসল্যান্ড।

তবে তারপর পর বিস্ময়করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আইসল্যান্ডের জাতীয় অর্থনীতি এবং ২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ২০০৮ সালের তুলনায় দেশটির অর্থনীতির আকার বেড়েছে।

আর্জেন্টিনা

ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রা পেসোর মান সবসময় অপরিবর্তিত রাখার বিপজ্জনক নীতি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের কারণে ২০০১ সালে ধস নেমেছিল দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ দেশ আজেন্টিনার অর্থনীতিতে। তার ফলে ১০ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ রেখে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল দেশটির তৎকালীণ সরকার।

রাশিয়া

বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়ার এযাবৎকালের ইতিহাসে অন্তত ৯ বার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল রাশিয়া্। এ সময় দেশটির ওপর ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ‍ঋণের বোঝা ছিল। এই ঋণ তৎকালীন রুশ সরকার নিয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে।

মূলত রুবলের মান পড়ে যাওয়া ও পুঁজিবাজারে ধসের কারণেই এই বিপর্যয়ে পড়তে হয়েছিল রাশিয়াকে।

মেক্সিকো

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে ১৯৮২ সালে। ওই সময় দেশটির ওপর ঋণের দায় ছিল ৮০০ কোটি ডলার। দুর্বল অর্থনৈতিক নীতি ও নিজেদের মুদ্রা মেক্সিকান পেসোর মূল্য ক্রমাগত কমতে থাকই ছিল মেক্সিকোর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।

লেবানন

পশ্চিম এশিয়ার দেশ লেবাননে অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয় ২০১৯ সালে। তৎকালীন সরকারের স্বেচ্ছাচারী করনীতি, অনিয়মিত ও অবৈধ পুঁজির দৌরাত্ম্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনগণের সঞ্চয় কমে যাওয়ায় ৯ হাজার কোটি ডলার ঋণের চাপে পড়ে দেশটি যা দেশটির জিডিপির তুলনায় ১৭০ শতাংশ বেশি।

ফলে বাধ্য হয়েই ২০২০ সালের মার্চে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে লেবানন সরকার। লেবাননের অর্থনৈতিক সংকটকে গত দেড় বছরের বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সংকট বলে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক।

শ্রীলঙ্কা

নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ভারত মহাসাগরের ছোট দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটে পড়া এই দেশটি চলতি বছর এপ্রিলে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। বর্তমানে দেশটির ওপর ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে।

এসএমডব্লিউ