বিক্ষোভকারীদের বাড়ি ধ্বংসের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ
মুসলমানদের বাড়িঘর এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ভারতের অনেক শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সমালোচকরা, দেশটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিক্ষোভকারীদের শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে ‘বুলডোজার বিচারের’ ক্রমবর্ধমান ধরন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নুপুর শর্মা ও দলটির দিল্লি শাখার গণমাধ্যম প্রধান নবীন জিন্দালের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে করা নিয়ে মন্তব্যের জেরে ভারতের উত্তর প্রদেশে বিক্ষোভ-সহিংসতায় অংশ নেওয়া দুই অভিযুক্তের বাড়িঘর গত শনিবার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। রোববারও উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজ এলাকায় শুক্রবারের সহিংসতায় জড়িত একজন রাজনীতিকের বাড়ি ভেঙে ফেলে প্রশাসন। এ সময় ব্যাপকসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায় সেখানে।
বিজ্ঞাপন
ভিডিওতে দেখা যায়, বুলডোজার ব্যবহার করে প্রয়াগরাজের রাজনীতিবিদ জাভেদ মোহাম্মদের বাড়ির ফটক এবং বাইরের প্রাচীর ভেঙে ফেলা হচ্ছে। পুলিশ বলছে, শুক্রবার প্রয়াগরাজে বিক্ষোভ-সহিংসতায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অন্যতম ‘মূলহোতা’ রাজনীতিক জাভেদ। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে উত্তর প্রদেশ পুলিশ।
প্রয়াগরাজে শুক্রবার জুমার নামাজের পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল এবং পাথর নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা। প্রয়াগরাজের সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে পুলিশের।
গত এপ্রিলে নয়াদিল্লি কর্তৃপক্ষ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের মালিকানাধীন দোকান-পাট বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। পরে অন্যান্য রাজ্যেও একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যায়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিশেষজ্ঞ এবং মোদির জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় মার্কিন বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, ‘মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস করা সাংবিধানিক নিয়ম এবং নীতির চরম লঙ্ঘন।’
মঙ্গলবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং হাই কোর্টের সাবেক বিচারক, আইনজীবীসহ অন্তত ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি দেশটির প্রধান বিচারপতির কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে প্রধান বিচারপতিকে বাড়িঘর ধ্বংসের বিষয়ে শুনানির আহ্বান এবং এই ঘটনাকে সামষ্টিক বিচারবহির্ভূত শাস্তি বলে অভিহিত করেছেন তারা।
তারা উত্তর প্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের সহিংসতাকে ব্যবহার করে ভিন্নমত দমনের অভিযোগ করেছেন।
শুক্রবার ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। বিশ্বের কয়েকটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ বিজেপির দুই নেতার মহানবীকে (সা.) নিয়ে করা মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা এবং নিন্দা জানিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এছাড়া ওই অঞ্চলে ভারতীয় পণ্য বর্জনেরও ডাক দিয়েছেন অনেকে। ফলে কূটনৈতিক দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে ভারত।
সমালোচকরা বলছেন, নুপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দালের মন্তব্য ভারতের গভীর ধর্মীয় মেরুকরণের প্রতিফলন; যা গত কয়েক বছর ধরে দেশটিতে দেখা গেছে। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বক্তব্য এবং আক্রমণ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তারা বলছেন, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সংঘাতপূর্ণ পথ অনুসরণ করে ভারতকে ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র’ এবং ‘দেশবিরোধী’ বিরোধীদের জায়গা এখানে হবে না বলে একটি মতাদর্শ প্রচার করছে। বিজেপির এই মতার্দর্শ দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমদের প্রান্তিক করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন অনেক মুসলিম। ভারতের ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ মুসলিম।
খাবার অথবা পোশাক অথবা আন্তঃধর্মীয় বিয়ের জন্য ভারতে মুসলিমরা বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল বিজেপির বিরুদ্ধে কখনও কখনও মুসলিমদের ‘পর’ হিসেবে দেখা এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ করেছে। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই রাজনৈতিক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত শুক্রবারের বিক্ষোভ এবং সহিংসতায় জড়িত সন্দেহে উত্তর প্রদেশে এখন পর্যন্ত ৩ শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে রাজ্য পুলিশ। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পরিবেশ খারাপ করার চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
রোববার বুলডোজার দিয়ে জাভেদ মোহাম্মদের বাড়ি একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। বাড়িটি অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে প্রশাসন দাবি করলেও জাভেদ মোহাম্মদের আইনজীবী এবং পরিবার তা অস্বীকার করেছে। ভারতের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের নেতা শওকত আলী বলেছেন, বাড়িটি যদি অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তাহলে আগে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? বাড়িটি ভাঙতে সরকার কেন দাঙ্গার অপেক্ষা করল?
সূত্র: এপি।
এসএস