এবার চালের রপ্তানির লাগাম টানতে যাচ্ছে ভারত, বিপর্যয়ের শঙ্কা
গম এবং চিনি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এবার খাদ্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে চালের রপ্তানির লাগাম টানতে যাচ্ছে ভারত। দেশীয় বাজারে চালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত ও মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে ভারত এই সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে দেশটির কয়েকটি সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গম এবং চিনির রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর ভারতের পরবর্তী খাদ্য সুরক্ষামূলক পদক্ষেপের লক্ষ্য হতে পারে চাল। আর ভারত এমন পদক্ষেপ নিলে তা বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বিজ্ঞাপন
এর আগে, গম এবং চিনি রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাজারে ব্যাপক টালমাটাল অবস্থা তৈরি করে। ভারতের নিষেধাজ্ঞার পরপরই বিশ্বজুড়ে এই দুই খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। ভারতের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশও নানা ধরনের খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে লাগাম টানছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গম এবং ভুট্টার দাম যখন আকাশচুম্বী তখন বিশ্বের শীর্ষ রপ্তানিকারক এই দেশটি চালের ক্ষেত্রে একই ধরনের পদক্ষেপ নিলে তা বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার মুখোমুখি করবে এবং মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি তৈরি হবে।
ইয়েস ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ রাধিকা পিপলানি বলেছেন, সরকার ইতোমধ্যে গম রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ ধরনের সব পদক্ষেপ খাদ্যের দাম কমিয়ে দেবে কিনা এবং কতদিন পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে এখন সেটিই দেখার বিষয়।
চালের রপ্তানি নিষিদ্ধের পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে ভারতের খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।
ভারত পর্যাপ্ত পরিমাণের চেয়েও বেশি চাল মজুত করেছে এবং দেশটির বাজারে এখন অন্যতম এই খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভারতীয়দের খাদ্যতালিকায় গমের সাথে চালও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়া দেশটিতে সরকারি যে রেশন দেওয়া হয় তাতেও চাল রয়েছে।
খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির জন্য সরকারিভাবে গম ক্রয় আগের বছরের তুলনায় চলতি বছরে অর্ধেকেরও কম হবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং দেশটির সরকার দরিদ্রদের মাঝে আরও চাল বিতরণের পরিকল্পনা করেছে। এর ফলে কর্তৃপক্ষ দেশীয় সস্তা চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
চীনের পর বিশ্বে চালের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী ভারত এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে চাল রপ্তানি করেছে। দেশটির কর্মকর্তারা বলেছেন, পাঁচটি পণ্যের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গম এবং চিনি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
নয়াদিল্লির সূত্রগুলো বলছে, চাল রপ্তানির সর্বোচ্চ সীমা চিনির মতো এক কোটি টন নির্ধারণ করা হতে পারে। দেশটির সরকার ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। চলতি বছরে মুদ্রাস্ফীতির হার গত আট বছরের সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশে পৌঁছেছে।
ভারতীয় দৈনিক ইকোনমিক টাইমস বলছে, সরকার দেশের বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত এবং দাম বৃদ্ধি ঠেকাতে চাল রপ্তানি সীমিত করার কথা বিবেচনা করতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি বাসমতি ব্যতীত অন্যান্য জাতের চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন বিশ্লেষণ করছে। দাম বৃদ্ধির কোনও লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশটির সরকারি একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে পত্রিকাটি এসব তথ্য জানিয়েছে।
বিশ্বের অনেক অংশের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য শস্য চাল; যা বিশ্ব খাদ্য সংকট পরিস্থিতিকে আরও খারাপ হওয়া থেকে রক্ষায় সাহায্য করছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গম এবং ভুট্টার প্রধান রপ্তানিকারক দুই দেশ ইউক্রেন-রাশিয়ার সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। যে কারণে এই দুই খাদ্যশস্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গম-ভুট্টার দাম বাড়লেও প্রচুর উৎপাদন এবং পর্যাপ্ত মজুতের কারণে বিশ্বে চালের দাম তেমন বৃদ্ধি পায়নি।
কিন্তু ভারত রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে চালের দামের সেই চিত্র বদলে যেতে পারে। তখন ভারতের মতো অন্যান্য দেশও চাল রপ্তানি বন্ধ করতে পারে, যা ২০০৮ সালে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের সময় দেখা গেছে। ওই সময় ভারত চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই ভিয়েতনামও চালের রপ্তানি বন্ধ করে।
চালের ৯০ শতাংশ উৎপাদন এবং ব্যবহার হয় এশিয়ায়। এছাড়া বিশ্ববাজারে রপ্তানি হওয়া মোট চালের প্রায় ৪০ শতাংশ যায় ভারত থেকে। ভারতের চাল রপ্তানিকারকদের সংগঠন রাইস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বি. ভি. কৃষ্ণ রাও বলেছেন, দেশে বর্তমানে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে এবং রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা অথবা বিধি-নিষেধ আরোপের দরকার নেই।
তিনি বলেন, তারপরও যদি সরকার কিছু পরিমাণে রপ্তানি বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চায়, তাহলে সেটি রাজনৈতিক বিবেচনায় হতে পারে। তবে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় তারা সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তে স্বাগত জানাবেন।
কোটাক ইনস্টিটিউশনাল ইক্যুইটিজের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ শুভদ্বীপ রক্ষিত বলেছেন, চাল রপ্তানি সীমিত করার সিদ্ধান্ত আগামী সপ্তাহগুলোতে দাম কেমন হবে তার ওপর নির্ভর করছে। ধান রোপণ এবং এর ফলনও নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর। বর্ষাকালে আবহাওয়া পরিস্থিতি যদি অস্বাভাবিক হয় এবং চালের দাম বেড়ে যায়, তাহলে রপ্তানি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দৈর্ঘ্য এবং আকারের ওপর নির্ভর করে চালের জাত শনাক্ত করা হয়। বাসমতি চাল একটু লম্বা এবং সুঘ্রাণের জন্য পরিচিত। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টন বাসমতি চাল রপ্তানি করেছে। একই সময়ে দেশটির বাসমতি নয়, এমন চাল রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক কোটি ৭৭০ লাখের বেশি টন।
• সোমালিয়ায় না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে শিশুরা
এসএস