নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন অমিত শাহ

ভারতে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে ওই রাজ্যে রাজনৈতিক সফরে এসে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি নেতা অমিত শাহ বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যুকে আবার খুঁচিয়ে তুলেছেন। খবর বিবিসি অনলাইনের। 

বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও ঠাকুরনগরে দুটি জনসভা থেকে অমিত শাহ দাবি করেছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে সীমান্ত দিয়ে ‘কোনও মানুষ দূরে থাক— একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না।’

ইদানিং খুব ঘন ঘন তিনি পশ্চিমবঙ্গ সফরেও আসছেন অমিত শাহ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অনুপ্রবেশ ইস্যুর আড়ালে বিজেপি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা নিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য দাবি করছে, তাদের শাসনামলে অনুপ্রবেশ মদত পেয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার যে অভিযোগ করেছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও অনেকেই মনে করছেন কথিত অনুপ্রবেশ ইস্যুর আড়ালে বিজেপি আসলে সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকেই সামনে আনতে চাইছে।

বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচন মাত্র মাস দুয়েক দূরে— আর সে রাজ্যে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান চ্যালেঞ্জার বিজেপির প্রচারণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেই।

ইদানিং খুব ঘন ঘন তিনি পশ্চিমবঙ্গ সফরেও আসছেন— এবং আজ (বৃহস্পতিবার) সবশেষ সফরে রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে তিনি দুটো বড় জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী কালিন্দী নদীতে প্রহরারত বিএসএফ

কোচবিহার ও ঠাকুরনগরে এই দুটো জনসভা থেকেই তিনি পরিষ্কার করে দেন, বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যু ভোটে বিজেপির জন্য বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে যাচ্ছে।

বিজেপির সাবেক সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘অনুপ্রবেশ নিয়ে আপনারা বিরক্ত কি না বলুন? আর মমতা বন্দোপাধ্যায় কি আদৌ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারবেন?’

তিনি এ প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলেন, ‘জেনে রাখুন, রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তবেই কেবল অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে। বিজেপি সরকার গড়লে সীমান্ত দিয়ে মানুষ তো দূরে থাক— একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না দেখে নেবেন!’

কোচবিহার বা ঠাকুরনগরে অমিত শাহ যখন এ কথা বলছেন— ঘটনাচক্রে ঠিক তার আগের দিনই তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশটির পার্লামেন্টে লিখিত জবাবে জানানো হয়েছে, ২০১৬ সালের তুলনায় পরের পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের ঘটনা ক্রমশ বিপুল হারে কমেছে।

তৃণমূলের যে এমপি মানসরঞ্জন ভুঁইঞার প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই উত্তর দিয়েছে, তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অমিত শাহ’র এই বক্তব্য তাই পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা এমপি মানসরঞ্জন ভুঁইঞা

ভুঁইঞার কথায়, ‘আন্তর্জাতিক সীমান্তে বেড়া দেওয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, সেই বেড়া দেওয়ার কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এছাড়া বাইরের দেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ভারতে ঢুকবেন, তাদের বাধা দেওয়া বা তাদের ওপর নজরদারি করার কথাও বিএসএফের— যারাও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বাহিনী।’

তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘ফলে কী করে তারা অনুপ্রবেশের জন্য মমতার সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারেন?’

বিবিসিকে তিনি আরও বলেন, ‘আমার প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকারই তো বলেছে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ কমে গেছে, তারপরও এসব কথা বলার অর্থ নিছক রাজনীতির জন্য রাজনীতি করা, নেহাত বলার জন্য বলা।’

তৃণমূল নেতা মানস রঞ্জন ভুঁইঞা বলেন, ‘এটা জেনে রাখুন, আমার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তার সরকার সব ব্যাপারেই সজাগ এবং তিনি কখনোই অনুপ্রবেশকে মদত দেন না, দেন না, দেন না।’

কলকাতায় নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ডিসেম্বর, ২০১৯

কলকাতার প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাবেক সাংবাদিক শিখা মুখার্জি মনে করেন, ‘এই অনুপ্রবেশের ইস্যু উসকে দেওয়ার পেছনে বিজেপির সাম্প্রদায়িক তাস খেলার চেষ্টাই আসলে কাজ করছে।’

শিখা মুখার্জি কথায়, ‘অনুপ্রবেশের ভয় দেখিয়ে বিজেপি আসলে এটাই বলতে চায় যে, বাংলাদেশ থেকে দলে দলে মুসলিমরা এসে পশ্চিমবঙ্গে কোনো এক প্রক্রিয়ায় হিন্দুদের সংখ্যালঘু বানিয়ে দেবে। ফলে এটা একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বক্তব্য— আর এ কথাটা যাতে বলা যায় সে জন্যই অনুপ্রবেশের ইস্যুকে প্রক্সি বা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

এদিকে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান এনে ভারত সরকার পার্লামেন্টে যে নাগরিকত্ব আইন পাস করেছে, প্রায় সোয়া বছর পরও তার বাস্তবায়ন এখনো শুরু হয়নি।

আর এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দু— যারা অনেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ থেকেও ভারতে এসেছেন— তাদের মধ্যে অসন্তোষও তীব্র হচ্ছে দিন দিন।

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বক্তব্য : অনুপ্রবেশ ঠেকানোর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের

বৃহস্পতিবার কিন্তু ঠাকুরনগরের জনসভাতেও মতুয়াদের সামনে অমিত শাহ নির্দিষ্ট করে কোনো তারিখ বলতে পারেননি যে তারা কবে থেকে এই আইন রূপায়নের প্রক্রিয়া শুরু করবেন।

শিখা মুখার্জি বলছেন, ‘আসলে এর দুটো দিক আছে। প্রথমত; আসামে ও ভারতের সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আর সেই আসামেও সামনেই ভোট আসছে। এখন অমিত শাহ নাগরিকত্ব আইন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যা-ই বলুন, আসামের মানুষও তো সেটা জানতে পারবে। আসামেও তার প্রতিফলন ঘটবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয়ত; এই আইনের ভিত্তিও কিন্তু ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার যারা, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া। ফলে আবার সেই ঘুরেফিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকেই খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে।’

আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে একই সঙ্গে ভোট অনুষ্ঠিত হবে এবং দুই রাজ্যে দুরকম রাজনৈতিক বাস্তবতায় নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিজেপি কীভাবে এগোবে সেটা তাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলেই দেখা যাচ্ছে।

এএস