ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না কেন?
ব্রাসেলসে বিশেষ সম্মেলনে অংশ নেওয়া পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর নেতারা পূর্ব ইউরোপে তাদের সৈন্যসংখ্যা বড় আকারে বৃদ্ধির অনুমোদন দিতে পারেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলায় ন্যাটোর নেতারা ব্রাসেলসে শুরু হওয়া সম্মেলনে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন।
ব্রিটেনসহ ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র ইতিমধ্যে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো শুরু করেছে। ইউক্রেনে ন্যাটো জোটের সদস্যদের অস্ত্র পাঠানোর ঘটনাকে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে উল্লেখ করে রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীকে বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
বিজ্ঞাপন
ন্যাটো কি?
ন্যাটো— যা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের সংক্ষিপ্ত রূপ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ১২টি দেশকে নিয়ে ১৯৪৯ সালে এই সামরিক জোট গঠন করা হয়। যেকোনও সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার সময় একে অন্যের সহায়তায় পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে গঠিত হয়।
মূলত ইউরোপে যুদ্ধ পরবর্তী রাশিয়ার সম্প্রসারণের হুমকি মোকাবিলা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৫৫ সালে ন্যাটোর পাল্টা হিসেবে পূর্ব ইউরোপীয় কমিউনিস্ট দেশগুলোর নিজস্ব সামরিক জোট গঠন করে, যা ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’ নামে পরিচিত।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়ারশ প্যাক্টভুক্ত কয়েকটি দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়। ন্যাটো জোটের সদস্য সংখ্যা এখন ৩০।
ইউক্রেন কেন ন্যাটোর সদস্য নয়?
ন্যাটো মূলত ২০০৮ সালে ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দ্বীপ দখলে নেওয়ার পর ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার হিসেবে নেয়।
কিন্তু সেটি আর হয়নি, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান করতে না পারার পেছনে প্রতিবেশি রাশিয়ার দীর্ঘদিনের বিরোধিতা অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। পূর্ব ইউরোপে নতুন সদস্য করে ন্যাটো ভূখণ্ড দখলে নিচ্ছে বলে আশঙ্কা করছে রাশিয়া। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদান করলে এই জোটের সৈন্যকে রাশিয়ার আঙ্গিনায় আনা হবে বলে অভিযোগ করেছে মস্কো।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এখন মেনে নিয়েছেন যে, তার দেশ ন্যাটোতে যোগদান করতে পারবে না। তিনি বলেছেন, ‘এটি পরিষ্কার, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। আমরা সেটি বুঝতে পেরেছি।’
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও একই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘খুব শিগগিরই ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের কোনও পথ নেই।’
আগ্রাসন শুরুর আগে রাশিয়ার অন্যতম একটি দাবি ছিল, ‘ইউক্রেনকে কখনই ন্যাটোতে যোগদান করতে দেওয়া হবে না। তবে পশ্চিমা এই জোট রাশিয়ার সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।’
ইউক্রেনে কেন সৈন্য পাঠাচ্ছে না ন্যাটো?
ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়, যে কারণে এই জোট দেশটির প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসতেও বাধ্য নয়। ন্যাটো দেশগুলোর আশঙ্কা, ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর সঙ্গে যদি তাদের সৈন্যরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটি রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে সর্বাত্মক সংঘাতের দিকে মোড় নিতে পারে।
মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য ন্যাটোর সদস্যরা সাধ্য অনুযায়ী কাজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে যুদ্ধ যেন ইউক্রেনের সীমানার বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্বও রয়েছে তাদের।
আর এই কারণেই ইউক্রেনের আকাশে নো-ফ্লাই জোন আরোপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে ন্যাটো। তবে স্টলটেনবার্গ বলেছেন, নেতারা এই অঞ্চলে জোটের উপস্থিতি দ্বিগুণ করে স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়ায় চারটি নতুন যুদ্ধদল পাঠাতে রাজি হবেন।
তিনি বলেন, রাশিয়াকে অবশ্যই পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি-ধমকি বন্ধ করতে হবে। এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে রাশিয়ার মন্তব্য
‘অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে বর্ণনা করেছেন ন্যাটোর এই মহাসচিব।
পশ্চিমারা ইউক্রেনকে কীভাবে সাহায্য করছে?
রাশিয়ার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য সহায়তা হিসেবে বেশ কয়েকটি ন্যাটো দেশ ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত সামরিক সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি ইউক্রেনে প্রাথমিকভাবে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এবং পরবর্তীতে আরও সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাংক-বিধ্বংসী জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান-বিধ্বংসী স্টিংগার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বডি আর্মার।
যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউক্রেনে সহায়তা বৃদ্ধি করে দেশটিতে এক বিলিয়ন ডলারের নিরাপত্তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ইউক্রেনে আরও অত্যাধুনিক দূরপাল্লার অস্ত্র ও ড্রোন রয়েছে। ন্যাটোর অন্যান্য সদস্যদেরও ইউক্রেনে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে ওয়াশিংটন।
পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর কত সৈন্য আছে?
উত্তরের বাল্টিক অঞ্চল থেকে দক্ষিণের রোমানিয়া পর্যন্ত ন্যাটোর সৈন্য রয়েছে এবং এখন আরও সৈন্য মোতায়েন করছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে এই সৈন্যরা সেখানে অবস্থান করছে।
ন্যাটো এখন রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে আরও ৪০ হাজার সৈন্যের শক্তিশালী মোকাবিলা বাহিনী পাঠাচ্ছে। ওই অঞ্চলে ১০০টি যুদ্ধবিমান, তিনটি ক্যারিয়ার গ্রুপসহ ১২০টি জাহাজ উচ্চ-সতর্ক অবস্থায় মোতায়েন রেখেছে; যারা উত্তর থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমুদ্রে টহল দিচ্ছে।
জোটের মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘আমরা প্রত্যেক মিত্র এবং ন্যাটো অঞ্চলের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করব।’
এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে আরও সৈন্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মার্কিন এই সৈন্যরা এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডে ন্যাটোর চারটি বহুজাতিক যুদ্ধ গ্রুপ এবং রোমানিয়ায় বহুজাতিক ব্রিগেডে যোগ দেবে।
সূত্র: বিবিসি।
এসএস