ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মারিউপোলের দখল নিতে মরিয়া রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। এ লক্ষ্যে জোরদার হামলা চালিয়ে যাওয়া রুশ সেনাদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের সংঘর্ষ চলছে। রুশ সেনাদের টানা অবরোধের সঙ্গে উভয়পক্ষের হামলা ও পাল্টা হামলায় যেন মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনীয় এই শহরটি।

রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মধ্যেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করা এই শহরটির তথ্য তুলে ধরেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। সোমবার (২১ মার্চ) এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইউক্রেনের মারিউপোলের আইনপ্রণেতা ইয়ারোস্লাভ ঝেলজনিয়াক তার নিজের শহরের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘পৃথিবীর নরক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বিবিসি বলছে, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর কয়েকদিন পর থেকেই মারিউপোল শহরটি অবরুদ্ধ করে রেখেছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। যার ফলে শহরটিতে মানবিক সাহায্য বিতরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় করিডোর তৈরির কাজও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

মূলত মারিউপোল শহরের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। প্রায় ৩ লাখ বেসামরিক মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে শহর থেকে বের হতে পারেননি। অল্প কিছু বেসামরিক নাগরিক যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন তারা মারিউপোলের ভয়ানক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছেন, খাবার সরবরাহ ফুরিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শহরে বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

এছাড়া ফুরিয়ে আসছে চিকিৎসা সরঞ্জামও। ফলে অবরোধ ও যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকট আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষুধা ও রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, স্থলপথ, আকাশপথ এবং সমুদ্রপথের মাধ্যমে মারিউপোল শহরে অনবরত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। আর এ কারণে শহরের বাসিন্দারা তাদের বেশিরভাগ সময়ই আশ্রয়কেন্দ্র এবং বেজমেন্টে কাটাচ্ছেন।

ইউক্রেনের ইরপিন শহরের রাস্তায় ঢেকে রাখা মৃতদেহ। গত ৬ মার্চের ছবি

মারিউপোলের প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি শহর দেখা যাচ্ছে। এমনকি শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে। বিবিসি’র সংবাদদাতা হুগো বাচেগা বলছেন, গত সপ্তাহে শহরটির মেয়র ভাদিম বয়চেঙ্কো বলেছিলেন- মারিউপোল শহরের ৮০ শতাংশের বেশি আবাসিক ভবন হয় ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব ভবনের এক-তৃতীয়াংশ আবার মেরামতের অযোগ্য।

বিবিসি বলছে, যুদ্ধের মধ্যে নিহতদের মরদেহ রাস্তায়ই ফেলে রাখা হচ্ছে, কারণ এসব মৃতদেহ উদ্ধার করতে যাওয়াও অনেক বিপজ্জনক। এর মধ্যে কারও মৃতদেহ চূড়ান্তভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও সেগুলো অনেকের ঠায় হচ্ছে গণকবরে। আর এটিই মারিউপোল শহরে ভয়াবহতার আরেকটি প্রতীক।

এমনকি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর একজন জেনারেলও স্বীকার করেছেন যে, মারিউপোল শহরে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য এর পেছনে নিজের (রুশ) বাহিনীর দায় রয়েছে বলে স্বীকার করেননি তিনি।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়ান সৈন্যরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইউক্রেনে এই হামলা শুরু করে। একসঙ্গে তিন দিক দিয়ে হওয়া এই হামলায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে বৃষ্টির মতো।

সর্বাত্মক হামলা শুরুর পর এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির বহু শহর কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ৩০ লাখেরও বেশি ইউক্রেনীয়।

উল্লেখ্য, প্রায় পাঁচ লাখ বাসিন্দার মারিউপোল শহরটি দখল করা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি আজভ সাগরে ইউক্রেনের কৌশলগত বন্দর এবং ডনবাস অঞ্চলে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর কাছেই অবস্থিত।

টিএম