ইউক্রেনের সৈন্যরা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে কিয়েভ থেকে দূরে রাখার জন্য কঠোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে কিয়েভের ভূ-প্রকৃতিও তাদের সহায়তা করছে। রাজধানীর প্রতিরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউক্রেন আর্মির দুই জেনারেল সোমবার বিবিসির সঙ্গে আলাপে এসব কথা বলেছেন। কেন তারা বিশ্বাস করেন কিয়েভ শহরের এমন সক্ষমতা রয়েছে যা রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে সব ধরনের পার্থক্য তৈরি করবে, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তারা।

রাশিয়ার ধ্বংসাত্মক গোলাবারুদের পাশাপাশি যুদ্ধের তাপ আরও তীব্রভাবে অনুভব করছে কিয়েভ। সোমবার সকালের দিকে কিয়েভের ৯ তলা একটি ভবনে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এতে অন্তত একজনের প্রাণহানি ঘটে। ধ্বংস হয়ে যায় ভবনটি। ওই ভবনের কয়েক ডজন বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েন। ভবনের অনেক বাসিন্দাকে আশ্রয়কেন্দ্রে না নেওয়া হলে সেখানকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো।

কিন্তু কিয়েভের উপকণ্ঠের অনেক শহরে এখনো রাশিয়ার অস্ত্রের আঘাত লাগেনি। অন্যদিকে, দেশটির অন্যান্য শহরে ভারী গোলাবর্ষণ চলছে এবং অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। কিয়েভের বাসিন্দাদের প্রায় অর্ধেক ইতোমধ্যে পশ্চিম ইউক্রেনে চলে গেছেন অথবা দেশ ছেড়েছেন। বাকি যারা শহরটিতে রয়েছেন তাদেরও একই নৃশংস অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কিয়েভকে বাঁচাচ্ছে নদ-নদী আর জলাভূমি

কিয়েভের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা জেনারেলরা বলেছেন, তারা রুশ কামানকে শহরের সীমানার বাইরে রাখার জন্য কঠোর লড়াই করছেন। তারপরও রাজধানী শহরটি ক্ষেপণাস্ত্রের ঝুঁকিতে আছে বলে স্বীকার করেছেন তারা।

তবে রুশ সৈন্যদের কিয়েভের বাইরে রাখতে শহরটির ভূ-প্রকৃতি ও বিস্তৃত উঁচু-নিচু ভূখণ্ডও সহায়তা করছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন জেনারেল আন্দ্রি ক্রিসচেঙ্কো। তিনি বলেন, শহরটি অনেক বড় এবং বিস্তৃত, এটি নদী দ্বারা বিভক্ত। কেবল প্রমত্তা ডিনিপার নদীই নয়, যা কিয়েভকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে, এর অনেক উপনদীও কিয়েভের আশপাশে রয়েছে।

রুশ সৈন্যদের কিয়েভের বাইরে রাখতে শহরটির ভূ-প্রকৃতি ও বিস্তৃত উঁচু-নিচু ভূখণ্ড সহায়তা করছে বলে জানিয়েছেন জেনারেল আন্দ্রি ক্রিসচেঙ্কো

তিনি বলেন, ‘এই দিক থেকে শহরটি রক্ষা করা কঠিন। কারণ এটি অনেক বড়। অন্যদিকে, এটি এক ধরনের বাড়তি সুবিধাও। কারণ শহরের পথে বিভিন্ন নদ-নদী, সেতু রয়েছে। আমাদের সৈন্যরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এবং দুর্গ গড়ে তুলছে।’

ইউক্রেনের এই জেনারেল বলেন, ‘শহরের চারপাশে অনেক ছোট নদী রয়েছে; যা ডিনিপারে গিয়ে পড়েছে। এছাড়া অনেক জলাভূমি রয়েছে। এর মানে হলো— বৃহৎ পরিসরে সেনাবহর চলাচলের উপযোগী নয় এই এলাকা।’

জেনারেল আন্দ্রি ক্রিসচেঙ্কোর মতে আরেকটি সুবিধা হলো, কিয়েভ একটি শিল্প নগরী। যেখানে অনেক ওয়ার্কশপ, কারখানা রয়েছে। যা দুর্গ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কংক্রিটের ব্লক, বালুর ব্যাগ এবং বিভিন্ন ধরনের ট্যাংকরোধী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

জেনারেল ক্রিসচেঙ্কো ও জেনারেল নিয়াজেভ বিশাল পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে বিবিসির প্রতিনিধি জেরেমি বোওয়েনের সাথে কথা বলছিলেন। ওই পর্দায় কিয়েভ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকা রাশিয়ার সেনাদের গতিবিধি ট্র্যাক করছেন তারা।

তারা হামলা চালিয়ে কিয়েভ অভিমুখে রাশিয়ার সৈন্যদের দুটি অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সেই হামলার ব্যাখ্যা করে ওই দুই জেনারেল বলেন, রাজধানী কিয়েভের পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে রাশিয়ার সৈন্যদের অগ্রসর হতে থাকা পৃথক বহরে হামলা চালানো হয়েছে। কিয়েভ অভিমুখে রাশিয়ার আলোচিত যে ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈন্যবহর এগোচ্ছে, তারাও সেই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল।

হামলা চালিয়ে কিয়েভ অভিমুখে রাশিয়ার সৈন্যদের দু’টি অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলেছেন জেনারেল কিয়াজেভ

জেনারেলরা বলেছেন, ‘রুশ সৈন্যদের বহরে আক্রমণ চালানো হয়েছে এবং তাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এই বহর এখন আর হুমকি নয়।’

উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কৌশলগত সেতু

রাশিয়ার সৈন্যদের মনযোগের কেন্দ্রে রয়েছে কিয়েভের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। রুশ পদাতিক বাহিনী এই অঞ্চলের সবচেয়ে কাছে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন জেনারেল নিয়াজেভ। বর্তমানে রুশ সৈন্যরা মধ্য কিয়েভ থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ইরপিন নদীর অপর প্রান্তে অবস্থান করছে।

কিয়েভের আশপাশের এলাকায় সুসংগঠিত এবং সুসজ্জিত বাহিনী মোতায়েন করেছে ইউক্রেন; যারা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সব সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ইরপিন শহরের বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার মানুষ নদীর ধারে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া বাস্তুচ্যুতরা তাদের পোষ্য কুকুর ও বিড়ালও সেখানে নিয়ে গেছেন। এসব কারণে রুশ সৈন্যরা সেখানে অগ্রসর হতে পারছে না বলে জানিয়েছেন জেনারেল নিয়াজেভ।

তিনি বলেন, এমন সব জলাবদ্ধ নিম্নভূমি রয়েছে; যা রাশিয়ানরা অতিক্রম করতে পারছে না। সেখানে যদি ইউক্রেনীয় কোনো সৈন্য না থাকত, তাহলে তারা নদীতে পন্টুন ফেলে পার হতো। কিন্তু আমরা সেখানে আছি এবং আমরা তাদের ধ্বংস করতে চাই।

বিবিসির প্রতিনিধি জেরেমি বোওয়েনের সাথে ওই দুই জেনারেলের কথা বলার সময় একটি ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরিত হয়। এর পরপরই প্রথমটির কাছাকাছি এলাকায় আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটে। ওয়ার রুম থেকে বিস্ফোরণের শব্দ পরিষ্কারভাবে শোনা যায়। জুনিয়র এক কর্মকর্তা সেই সময় বলেন, ‘শুনুন। আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী।’

কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্রটি মাঝ আকাশে পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। যে কারণে মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় সেটির প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং বাসের একজন কন্ডাক্টর মারা যান। এছাড়া ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষের আঘাতে কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর এমন সফলতা তাদের বন্ধু এবং শত্রুদেরও বিস্মিত করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এবং কমান্ডাররা দেশটির সেনাবাহিনী এবং হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর কর্মদক্ষতায় অত্যন্ত খুশি। কিন্তু রাশিয়ানরা এখনো এই রাজধানী শহরে (কিয়েভে) তাদের পূর্ণশক্তির ব্যবহার করেনি।

এসএস