দেশে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আক্রান্তদের ১৭ শতাংশ পরিবারই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ক্যান্সার মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

তিনি বলেন, “ক্যান্সার মোকাবিলায় আরেকটি ‘ডায়াবেটিস সমিতি’ প্রয়োজন। তারা শুধু ক্যান্সার নিয়ে সারাদেশে কাজ করবে।” শুক্রবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এ আহ্বান জানান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : দেশে প্রতি বছর কত সংখ্যক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন? তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন?

ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ হাজারের মতো মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন। প্রতি মাসে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ রোগী আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন।

প্রতিদিন নতুন-পুরাতন রোগী মিলিয়ে দেড় হাজারের মতো মানুষকে আমরা আউটডোর, ইনডোর, অপারেশন, পেলিয়েটিভ কেয়ারসহ নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। আমাদের বর্তমানে যে জনবল ও অবকাঠামো রয়েছে, সেটা দিয়েই আমরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছি।

দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা সেবার বাইরেও অসংখ্য মানুষ সরকারি সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তাদের নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?

ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা অবকাঠামো আরও বিস্তার লাভ করছে। আমাদের অবকাঠামো বাড়ানোর একটি বড় পদক্ষেপ হলো, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের আট বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধীনে ৪৬০ শয্যা বিশিষ্ট সমন্বিত ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগ ইউনিটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি, সেবার বিকেন্দ্রীকরণ হবে। ফলে ক্যান্সার সেবার বৈষম্যও দূর হবে।

এছাড়া, আমরা খুব শিগগিরই ক্যান্সার নিয়ে সরাসরি একটি ওয়েবসাইট অবমুক্ত করব। সেখানে আমাদের ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে কনসালটেন্ট (পরামর্শদাতা) থাকবেন। তিনি এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের সরাসরি টেলিমেডিসিন সেবার আওতায় আনতে পারবেন। আমি মনে করি, ক্যান্সারের চিকিৎসা সেবায় বৈষম্য দূরীকরণে এটি ভালো একটি পন্থা হতে পারে।

আমরা এটি বাস্তবায়নের জন্য দ্বিপাক্ষিক অর্থাৎ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, পরবর্তীতে যেসব হাসপাতালে অবকাঠামোগতভাবে অনকোলজি সাপোর্ট নেই, তাদের সঙ্গে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে আমাদের চিকিৎসকরা যুক্ত হয়ে সেবা দেবেন। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হবে, আমরা যেন দ্রুততম সময়ে একজন রোগীর ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারি।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

পরবর্তীতে যেসব রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত, একসময় পৃথিবী ত্যাগ করবেন অর্থাৎ যাদের শুধু প্রশমন চিকিৎসা দরকার, তাদের সেবার আওতায় নিয়ে আসব। ক্যান্সারে মৃত্যুপথযাত্রী, কোনোভাবে যারা সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপিসহ এ জাতীয় চিকিৎসার আওতায় আসতে পারছেন না, আমরা চাই এ সেবাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যায়ে দিতে।

আমাদের হাসপাতালে যে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের একটি ইউনিট রয়েছে, এর সহায়তায় টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ক্যান্সারে বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে, তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে— এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং এ বিষয়ে আমরা খুবই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ঢাকা পোস্ট : আট বিভাগে ক্যান্সার হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হলে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে রোগীর চাপ কমবে কি?

ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : অনেকাংশেই চাপ কমবে। আমি শুরুতেই বলেছি, প্রতি বছর দেশে দেড় লক্ষাধিক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। সেই সংখ্যাকে যদি শুধুমাত্র ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল দিয়ে ভাগ করি, আবার সেটিকে যদি আট বিভাগের আরও ১৮০টি করে প্রায় দেড় হাজার শয্যা দিয়ে ভাগ করি, তাহলে তো রোগীর সংখ্যা এমনিতেই কমে আসবে। কারণ, এখন আমাদের আছে মাত্র ৫০০ শয্যা, তখন যোগ হবে আরও দেড় হাজার শয্যা। সবমিলিয়ে হবে দুই হাজার শয্যা।

ঢাকা পোস্ট : ক্যান্সারে আক্রান্তদের সেবায় বেসরকারি পর্যায়ে কোনো করণীয় আছে কি-না?

ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : ক্যান্সার হাসপাতালের শয্যা বাড়লেও শুধুমাত্র সরকারের ওপর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা কোনোভাবেই আমাদের উচিত হবে না। আমাদের ডোনার এজেন্সি আছে, সমাজের বিশিষ্ট উদ্যোক্তারা আছেন; যারা এ দুরারোগ্য ব্যাধিকে অ্যাড্রেস করতে পারেন। আমি তো মনে করি, আট বিভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তার কাছাকাছি না হলেও সমপর্যায়ের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

শুধুমাত্র সরকারের একার পক্ষে সবকিছুর সমাধান সম্ভব নয়, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে। ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে আমরা উদাত্ত আহ্বান থাকবে যে, প্রাইভেট সেক্টরের (ব্যক্তিগত খাত) লোকজন ব্যবসায়িক মনোভাব ত্যাগ করে, সেবার মানসিকতা নিয়ে ক্যান্সারের ওপর আলাদা ফোকাস দিয়ে এগিয়ে আসবেন। যেমন- আমাদের ডায়াবেটিস সমিতির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম স্যার, সশ্রদ্ধ চিত্তে আমরা তাকে স্মরণ করি। ডায়াবেটিস সমিতির আদলে জেলা পর্যায়ে যদি একটি ‘অনকোলজি অ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের মাধ্যমে সেবাকার্যক্রম পরিচালনা করা যায় এবং পর্যায়ক্রমে এর উন্নয়ন করা যায়, তাহলে জেলা পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত ও চিকিৎসা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

আমি আবারও বলছি, শুধুমাত্র সরকারের পক্ষে এককভাবে এত বড় একটা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমাদের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (অংশীদারিত্ব) আওতায় হলেও ৬৪ জেলাতে আমরা যেন সেবা বাড়াতে পারি, সেই মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।

শুধু ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আক্রান্তদের ১৭ শতাংশ পরিবারই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে / ছবি- সংগৃহীত

ঢাকা পোস্ট : ক্যান্সার প্রতিরোধে মানুষের করণীয় সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন...

ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : ক্যান্সার একটা ব্যয়বহুল চিকিৎসা। এটা মেটাতে গরিব মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও নিঃস্ব হতে হয়। এজন্য আমাদের শুরু থেকে প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে।

সবধরনের তামাক বর্জন, মেয়েদের ১৮ বছরের নিচে বিবাহ না দেওয়া এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে সহজেই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি খাবার টেবিলে নিয়মিত শাকসবজি রাখা, ফলমূল বেশি করে খাওয়া এবং তৈলাক্ত খাবার, রঙযুক্ত ফাস্ট ফুড, লাল মাংস ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকা গেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যেতে পারে।

এছাড়া ওজন সীমিত রাখা, প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটা ও হালকা ব্যায়াম করা এবং পরিবেশগত ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ক্যান্সার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।

টিআই/এমএআর/