মা থেকে শিশুর দেহে এইডস সংক্রমণ, জানেন না ২৮.৫ শতাংশ নারী
দেশের শতকরা ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন। অর্থাৎ এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের অন্তত একটি বাহক সম্পর্কে তাদের জ্ঞান আছে। ২০১৯ সালে যা ছিল ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্যামপল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২০’ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৩ সাল থেকে এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৪৯ বছরের নারীদের জ্ঞান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আসছে বিবিএস।
বিজ্ঞাপন
বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, মা থেকে শিশুর শরীরে এইচআইভি/এইডস সংক্রমণ হতে পারে এমন ধারণা সম্পর্কে অবগত নন ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। কমপক্ষে একটি বাহক সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। যা ২০১৯, ১৮, ১৭ ও ১৬ সালে যথাক্রমে ছিল ৭০ দশমিক ১, ৬৮ দশমিক ৯, ৬৮ দশমিক ৮ ও ৬৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
অন্যদিকে, সবগুলো বাহক সম্পর্কে অবগত ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ নারী। যা ২০১৯, ১৮, ১৭ ও ১৬ সালে ছিল যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ৫, ৩৪ দশমিক ৬, ৩৫ দশমিক ৫ ও ২৯ দশমিক ১ শতাংশ।
এইডসে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে ২০৫ জনের। বাংলাদেশে এইডস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫৮৮ জনের। বর্তমানে দেশে প্রায় আট হাজার রোগী চিকিৎসার আওতায় রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিএইডস
গত ১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের এইচআইভি/এইডস বিষয়ক সংস্থা ইউনিএইডস জানিয়েছে, বাংলাদেশে জনসংখ্যার বিচারে এখনও বেশি না হলেও এইডস রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ০ দশমিক ১ শতাংশ, যা সংখ্যার হিসেবে ১৪ হাজারের বেশি।
সংস্থাটি জানায়, এইডসে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে ২০৫ জনের। বাংলাদেশে এইডস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫৮৮ জনের। বর্তমানে দেশে প্রায় আট হাজার রোগী চিকিৎসার আওতায় রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিএইডস।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ এইডস আক্রান্ত ৯৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা হবে। তবে প্রাণঘাতী এ রোগ নিরাময়ে সরকারকে আরও বেশি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে এইডস শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা এবং আওতা আরও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, অভিবাসী, পুসব্যাক হওয়া জনগণ এবং বেশি আক্রান্ত পাওয়া এলাকাগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এছাড়া নতুন রোগীদের একটি বড় অংশ অভিবাসী কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্য। আগে ঝুঁকিপূর্ণ চার ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন রোগী বেশি পাওয়া গেলেও গত বছর সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বেড়েছে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, নতুনভাবে আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে নতুন শনাক্ত হয়েছেন ২১৮ জন। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১২৭ জন, খুলনায় ৬৪ জন, সিলেটে ৪৫ জন, বরিশালে ২৮ জন, রাজশাহীতে ২৭ জন এবং ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে ১৫ জন শনাক্ত হয়েছেন।
নতুন আক্রান্তদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে, ৭৪ দশমিক ২০ শতাংশ ২৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে, ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ ১৯ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে এবং ২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ ১০ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
‘শিশু, এইচআইভি ও এইডস : ২০৩০ সালের বিশ্ব’ প্রতিবেদনে ইউনিসেফ বলছে, এইডস-সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে এইচআইভি প্রতিরোধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রকল্পে বাড়তি বিনিয়োগ করা না হলে প্রতিদিন ৭৬ কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা বজায় থাকলে এইচআইভিতে আক্রান্ত শূন্য থেকে ১৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক দুই লাখ ৭০ হাজারে পৌঁছাবে। যা বর্তমানের অনুমানের চেয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম। বাংলাদেশেও এইডসের বর্তমান পরিস্থিতি প্রায় একই রকম বলে জানায় ইউনিসেফ।
গত বছরে আক্রান্ত নতুন রোগীর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ১৮৬ জন, বিদেশ ফেরত প্রবাসী ১৮৮ জন, বিদেশ ফেরতদের পরিবারের ১৪৪ জন, ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন, নারী যৌনকর্মী ১৭ জন, সমকামী ৬৭ জন, পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন এবং ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন রয়েছেন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রথম এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর থেকে ১০, ২০, ১০০ বা ২০০ জন করে নতুন রোগী প্রতি বছর শনাক্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন রোগী বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬৯ জনে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম কোনো রোগী মারা যায় ২০০০ সালে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে আরও ৭২৯ জনের দেহে এইচআইভি শনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৮৬ জন। তাদের নিয়ে দেশে এইচআইভি আক্রান্ত সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি।
গত বছরে আক্রান্ত নতুন রোগীর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ১৮৬ জন, বিদেশ ফেরত প্রবাসী ১৮৮ জন, বিদেশ ফেরতদের পরিবারের ১৪৪ জন, ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন, নারী যৌনকর্মী ১৭ জন, সমকামী ৬৭ জন, পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন এবং ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ও টিবি-লেপ্রোসী ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. খুরশীদ আলম বলেন, দেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার কম, মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সংক্রমণের হার কম হলেও ঘনবসতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং অসচেতনতার কারণে এইচআইভির ঝুঁকি রয়েছে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক বেশি হওয়ায় দেশের ঝুঁকি রয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের পর করোনার কারণে বৈধ ও অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া অনেকেই দেশে ফিরেছেন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সরকারি তথ্য মতে নতুন শনাক্ত হওয়া এইডস রোগীদের মধ্যে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বেশি। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও সংক্রমণের হার বেশি। কিন্তু এ সময়ে করোনা ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতের প্রতি সরকারের মনোযোগ ছিল। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরীক্ষার বাইরে কিছু জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে।
এছাড়া কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, অভিবাসীদের অনেকেই এইচআইভি আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। পরিসংখ্যান বলছে, এ সময়ের জরিপে এইচআইভিতে আক্রান্ত নতুন রোগীদের ৩০ শতাংশ অভিবাসী কর্মী বা তার পরিবারের সদস্য।
মায়েদের সংক্রমণের হার বেশি হওয়া প্রসঙ্গে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. জাহিদুল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেশে এইচআইভি রোগী কম। এর মধ্যে যারা রয়েছেন বা হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই বিদেশ ফেরত। প্রবাসীদের যখন এইডস হয়, তখন তারা নিজেরাও জানেন না। অধিকাংশ প্রবাসী বিদেশ থেকে এসে বিয়ে করেন বা সন্তান নেন। সেখান থেকেই মায়েদের এবং সন্তানদের শরীরে যায়। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাখ্যা। এটা আমার নিজের চোখে দেখা।’
তিনি বলেন, ‘এইডসের সংক্রমণ বেশি মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইতালিতে। বেশির ভাগ মানুষই জানে না তাদের এইডস হয়েছে। জানলেও বিভিন্ন কারণে গোপন রাখেন। এইডস দুভাবে ছড়ায়, শারীরিক মিলন ও রক্তের মাধ্যমে। দেশে এতদিন পর্যন্ত যত নারী আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের কেউই সরাসরি হননি। প্রত্যেকেই আক্রান্ত হয়েছেন শারীরিক মিলনের মাধ্যমে। এ রোগে আক্রান্ত নারীরা অপুষ্টিজনিত সন্তান জন্ম দেন। অনেক সময় সন্তান পেটে থাকতেই মারা যায়। আমাদের কাছে আসা রোগীগুলো একদম শেষপর্যায়ে আসেন। তখন আর কিছুই করার থাকে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহিদুল কবির বলেন, ‘একমাত্র সচেতনতাই পারে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে। এটি রোধে স্ক্রিনিং টেস্ট বাড়াতে হবে। দেশে এইডসের ঝুঁকি কম, রোগী বেশি। পাশের দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে যেকোনো সময় এইডস বাড়তে পারে বাংলাদেশ। কারণ, ভারত ও মিয়ানমারে এইডসের প্রচুর রোগী আছে। এজন্য প্রথমেই সচেতনতা বাড়িয়ে স্ক্রিনিং টেস্ট বাড়াতে হবে।’
‘এইডস নিয়ে কর্মসূচি প্রয়োজন’— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে দু-একটি এনজিও ছাড়া আর কারও তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। এইডস নিয়ে কর্মসূচির প্রয়োজন। এটি এমন একটা জিনিস, যেটার কর্মসূচি থাকলে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা অনুদান হিসেবে টাকা দেয়। আমাদের বিদেশি ফান্ড আসে ঠিকই কিন্তু এ টাকা হয়তো ফেরত যায়, নয়তো তারা খেয়ে ফেলে।’
‘যারা টাকা নিচ্ছে, তারা তো এক্সপার্ট না। দেশে কমন সমস্যা হচ্ছে, যে কাজটা যারা জানে, সে কাজে তাদের লাগানো হয় না। যার যে চেয়ারে বসার কথা, তারা তো সেই চেয়ারে নেই। আমরা যারা কাজ করছি তাদের এক কোনায় ফেলে রাখা হয়েছে।’
ডা. জাহিদুল কবির বলেন, ‘করোনার জন্য যে ল্যাব কেনা হয়েছে সেগুলোতে চাইলে এইডস টেস্ট করা যায়। শুধু এইডসের কিট দিলেই পিসিআর মেশিনে টেস্ট করা যাবে। এইডস টেস্ট কমিউনিটি বেজড করতে হবে। স্ক্রিনিং টেস্ট সুস্থ মানুষকে করা হয়। এ রোগের চিকিৎসা কমিউনিটি থেকেই উঠে আসতে হবে।’
এইডস নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কোনো ডাটাবেজ আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছু নেই। আমি কয়েক দিন আগে একটি আর্টিকেল লিখতে চেয়েছিলাম, আমাকেও দিতে পারেনি। আপনি যোগাযোগ করে দেখতে পারেন, কিছু দিতে পারবে না। কারণ, এটা নিয়ে কোনো কাজ হয় না। মিডিয়াতে এটা নিয়ে লেখালেখি করতে হবে। এজন্য আমি আবারও বলছি, আমাদের এখনই সচেতন হওয়া দরকার। কিছু বিষয় থাকে যেগুলো বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। এইচআইভি ঠিক তেমনই একটি রোগ। এ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি মিডিয়াও ভালো ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে প্রচারণার ক্ষেত্রে। সংবাদকর্মীরা এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে সচেতনতা তৈরিতে অবদান রাখতে পারে।’
এসআর/এমএইচএস