প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও কিডনি রোগসহ কোনো না কোনো ধরনের দুরারোগ্য অসংক্রামক ব্যাধিতে (কোমরবিড) আক্রান্ত রোগীরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে (২২ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর) করোনায় প্রাণ হারানোদের মধ্যে ৫২.০ শতাংশই ছিল কোমরবিড আক্রান্ত রোগী, যা এর আগের সপ্তাহে ছিল ৫১.৬ শতাংশ। 

এদিকে করোনা প্রতিরোধে দুই ডোজের টিকা নিয়েছেন এমন অনেকেরই ছয় মাস পেরিয়েছে, যাদের শরীরের অ্যান্টিবডি অনেকটাই কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী করোনার নতুন নতুন ধরনও দেশে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। এই অবস্থায় কোমরবিডিটিতে আক্রান্ত রোগীদের সংক্রমণ ঠেকাতে বুস্টার ডোজ প্রয়োগে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, টিকা দেওয়ার সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আগে বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ দেওয়া হবে না। তবে কোমরবিডিটিতে আক্রান্ত রোগীদের বুস্টার ডোজের বিষয়ে যদি টিকা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির (নাইট্যাগ) সুপারিশ আসে, তাহলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। 

অধিদফতরের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৬৯৬ জন, মারা গেছে মোট ২৫ জন। আর মারা যাওয়াদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ১৩ জনেরই কোনো না কোনো ধরনের দুরারোগ্য অসংক্রামক ব্যাধি বা কোমরবিড ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৬.৯ শতাংশ ডায়াবেটিসে, ৪৬.২ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে, ১৫.৪ শতাংশ বক্ষব্যাধি এবং ৩০.৮ শতাংশ হৃদরোগে ভুগছিল।

সারাদেশে টিকা গ্রহীতার সংখ্যা নয় কোটি ৬৯ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা ছয় কোটি দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৯ জন। এছাড়া দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা তিন কোটি ৬৬ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৬ জন।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই কোমরবিডিটিতে আক্রান্তরা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। ফলে এসব দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার এবং ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের কোভিড টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করেছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

‘ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন বিবেচনায় বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. ‍মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু মানুষকে বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে এই মুহূর্তে বুস্টার ডোজ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যারা একদম টিকা পায়নি তাদেরকে এই মুহূর্তে টিকার আওতায় আনা জরুরি। নির্দিষ্ট সবাইকে টিকা দেওয়ার পর আরো উন্নত সংস্করণের টিকা আসবে, তখন বুস্টার ডোজ দেওয়া যাবে।

তিনি বলেন, আমরা দেখি যে অনেকেরই কোমরবিডিটি কন্ডিশন থাকে, এছাড়াও বয়স্কদের ক্ষেত্রে যাদেরকে চিকিৎসকের বুস্টার ডোজের ব্যাপারে সুপারিশ থাকে, তাদেরকে দেওয়া যেতে পারে। কোনো একজন লোকের দেখা গেলো যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কমে গেছে, এক কথায় তার ক্লিনিক্যাল কন্ডিশনের কারণে যদি বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হয়, শুধুমাত্র তাদেরকেই দেওয়া যেতে পারে। কারণ করোনায় তাদের মৃত্যু হার অনেক বেশি। যে কারণে করোনা সংক্রমিত হওয়ায় ঝুঁকিও তাদের বেশি।

সংক্রমণ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মুশতাক হোসেন বলেন, যতদিন বিশ্ব থেকে করোনা দূর না হবে, ততদিন করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাবে। বিশ্বজুড়ে যেসব দেশে সংক্রমণ শূন্য হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোতে আবারও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, বেশকটি দেশ আবার লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমাদেরও যেকোনো সময় সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই কোনোভাবে এখানে শিথিল হওয়ার অবকাশ নেই।
 
‘সবার জন্য নয়, বয়স্ক-রোগাক্রান্তদের বিষয়ে ভাবা যেতে পারে’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে সাধারণ মানুষের জন্য এই মুহূর্তে কোনোমতেই বুস্টার ডোজের প্রয়োজন নেই। আমরা দেখছি যে, বুস্টার ডোজের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো বক্তব্যই আসছে না। তারা বলছে দুই ডোজ টিকা দেশের বেশিরভাগ মানুষকে দিয়ে দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চাইলে এখনও ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ টিকার বাইরে রয়ে গেছে। তাদেরকে টিকা না দিয়ে এখন যেসব টিকা আসছে সেগুলো থেকে যদি বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করি, তাহলে বাকি লোকগুলোর কী হবে? কিছুই হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হলো যত দ্রুত সম্ভব সারা পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষকে দুই ডোজের টিকা দিয়ে দেওয়া উচিত। এরপর বুস্টার ডোজের বিষয়ে চিন্তা করা যেতে পারে।

ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাতে ১৮ বছর ও তার অধিক বয়সী সব নাগরিককে করোনা টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। 

আবু জামিল ফয়সাল আরও বলেন, বুস্টার ডোজের ব্যাপারে এখন যেসব কথাবার্তা আসছে এবং যেসব দেশ শুরু করেছে, তারা শুধুমাত্র বয়স্ক ও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্তদের বিষয়ে বলছে। সুতরাং আমাদের দেশেও বয়স্ক-রোগাক্রান্তদের বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুধু বয়স্কদের দিতে বলেছে, আমেরিকার কিছু জায়গায় বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে।

‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে মাপকাঠি নয়, নিজস্ব নীতিমালায় তৃতীয় ডোজ দেওয়া প্রয়োজন’

শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আমরা অনেকটা ‘কপি-পেস্টের’ মতো অনুসরণ করি। তারা কিন্তু শুধু বাংলাদেশের উদ্বেগ নিয়ে চিন্তা করবে না, তারা উগান্ডা আর ব্রুনাইয়ের কথাও চিন্তা করবে। তারা দেখবে যে সেখানকার মানুষজন কম টিকা পেয়েছে, এ অবস্থায় তারা বলবে- আমরা কী করে বা কেন তৃতীয় ডোজ অনুমোদন করব? সুতরাং আমাদেরকে শুধু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনুসরণ করে বসে থাকলে হবে না, এসব ক্ষেত্রে দেশভিত্তিক নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত।

তিনি বলেন, এখন প্রতিটি ঘরেই জ্বর-সর্দি-কাশি লেগে আছে। যেগুলোকে আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখছি। যে কারণে করোনা টেস্টও আমরা করছি না। আমাদের যতটুকু সন্দেহ, অনেকে করোনায় আবারো আক্রান্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় তৃতীয় ডোজের ক্ষেত্রে চিকিৎসকসহ ফ্রন্টলাইনার যারা আছে, যাদের পাবলিক কমিউনিকেশন বেশি করা লাগে, ষাটোর্ধ্ব, এমনকি যাদের কমোরবিড কন্ডিশন আছে, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, লিভারের সমস্যা আছে, তাদেরকে তৃতীয় ডোজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কারণ এ সমস্ত লোকদের টিকা নেওয়ার পরও রিপিটেড ইনফেকশন (পুনরায় সংক্রমিত) হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আর পুনরায় যদি তারা সংক্রমিত হয়, তাদের মাধ্যমে আরো বেশি পরিমাণ কোভিড ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এজন্য এই সব লোকদের তৃতীয় ডোজ দিলে তারা যেমন সুরক্ষিত হবে, একইসঙ্গে কোভিড ছড়ানোর ঢেউটাও কমে যাবে। যে কারণে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশ তৃতীয় ডোজ দেওয়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং অনেকেই দেওয়া শুরু করেছে।

এখনও টিকার বাইরে অসংখ্য মানুষ, এ অবস্থায় তৃতীয় ডোজ সবাইকে দেওয়া উচিত হবে কি না- জানতে চাইলে আশরাফুল হক বলেন, এখনও টার্গেট করা জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের মতো মানুষ টিকার বাইরে রয়েছে, এ বিষয়টি যৌক্তিক। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি, মার্চে যারা টিকা নিয়েছিল, তাদের টিকায় সুরক্ষা ইতিমধ্যেই শেষ। তাদেরকেও যদি টিকা নেওয়া ২০ শতাংশ মানুষের সঙ্গে ধরে নেওয়া হয় যে, তারা সুরক্ষিত আছে, তাহলে ভুল হবে। আপনি কাগুজে হিসেবে ২০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা বললেও দেখা যাবে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি আছে, আর বাকিদের অ্যান্টিবডি অনেকটাই ডেডলাইনে চলে এসেছে। এ অবস্থায় কোভিডের ঢেউ যদি আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাহলে আগে টিকা নেওয়া বয়সোর্ধ্ব ও কোমরবিড আক্রান্তদের তৃতীয় ডোজ দেওয়া জরুরি হয়ে যেতে পারে। কারণ সামনে শীত আসছে, আর শীতের সময় বেশিরভাগ মানুষ ঘরের ভেতরেই থাকবে, ফলে একজন আক্রান্ত হলে তার থেকে বাকি পাঁচজনও আক্রান্ত হবে।

দেশে মোট নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাত কোটি ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৪৩৯ জন। তাদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সাত কোটি দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩৯২ জন ও পাসপোর্টের মাধ্যমে এক কোটি ৫৬ হাজার ৪৭ জন নিবন্ধন করেন।

ডোজ নিয়ে ভুল ধারণা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস টিকার ডোজ নিয়ে আমাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে। আমরা প্রথমত টিকার যে ডোজটি দেই, সেটি হলো প্রাইম ডোজ। যেটিতে অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু হয়। আর দ্বিতীয়বারে যে ডোজটি দেওয়া হয়, তাকে বলা হয় বুস্টার ডোজ। এর কাজ হলো প্রথম ডোজের মাধ্যমে যতটুকু অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, সেটিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিকে বুস্টআপ করা। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ১৪ দিন পর শরীরে অ্যান্টিবডি লেভেল সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। এরপরও যদি একপর্যায়ে শরীরের অ্যান্টিবডি কমে যায়, তখন আবারও যদি টিকা দেওয়া হয়, সেটিকে বুস্টার নয়, তৃতীয় ডোজই বলা হয়।

কোমরবিড রোগীদের তৃতীয় ডোজ : নাইট্যাগের সুপারিশ এলে সিদ্ধান্ত

কোমরবিডিটিতে আক্রান্ত রোগীদের বুস্টার ডোজের বিষয়ে যদি টিকা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির (নাইট্যাগ) সুপারিশ আসে, তাহলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডাক্তার নাজমুল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা বুস্টার ডোজ দেব, তবে আমাদের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা, তাদেরকে আগে দুই ডোজ সম্পন্ন করব। তারপর আমরা দেখব টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে কারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। হতে পারে যারা কোমরবিডিটিতে আক্রান্ত, হতে পারে সব বয়সোর্ধ্ব বা তরুণদের, তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নেব যে ওই জনগোষ্ঠীকে আমরা বুস্টার ডোজের আওতায় আনব। তবে কবে নাগাদ সেটা শুরু করব এটাই মুহূর্তে বলা কঠিন।

তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বুস্টার ডোজ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু সে দেশগুলোর সঙ্গে তো বাংলাদেশের অবস্থাকে মেলালে হবে না। কারণ আমরা তো এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারিনি। আমরা এখন পর্যন্ত ৬ কোটির বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজ দিয়েছি তিন কোটির বেশি মানুষকে। আমরা আগে ১২/১৩ কোটির মতো মানুষকে টিকার আওতায় আনব, তারপর বুস্টার ডোজ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করব।

নাজমুল ইসলাম বলেন, অনেকেই হয়তো মিথ্যা নিবন্ধন করে বা ফাঁকি দিয়ে, অবৈধ কোনো প্রক্রিয়ায় বুস্টার ডোজ নিয়ে ফেলেছে, আবার অনেকেই দেশের বাইরে গিয়ে ওখান থেকে ফাইজারের আরেক ডোজ টিকা নিয়ে এসেছে, তাদের বিষয়টি ভিন্ন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে অনুমোদন না দেয় এবং ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটি আমাদেরকে এই ব্যাপারে সুপারিশ না করে, তখন পর্যন্ত আমরা বুস্টার ডোজ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। নিলে হয়তো প্রশ্ন আসবে সাধারণ মানুষকে তো এখনো আপনার টিকার আওতায় আনতে পারেননি, এদিকে আরেকটি শ্রেণিকে আপনারা বুস্টার ডোজ দিয়ে দিচ্ছেন। সুতরাং এই শ্রেণিবিন্যাসটা আমরা চাই না।

সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, টিকা নেওয়ার পর যাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে অনেক আগে টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা নতুন টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি। একে টিকার প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসার প্রমাণ বলে মনে করছেন গবেষকরা।

টিকার মজুদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন তো আমাদের সাপ্লাই চেইনে পর্যাপ্ত টিকা রয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের প্রায় পাঁচ কোটি ডোজ টিকা থাকবে। আবার ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আমাদের যে ভ্যাকসিন কমিটমেন্ট আছে, সেগুলো যদি পেয়ে যাই, তাহলে প্রায় ১০ কোটি ডোজ টিকা আমাদের হাতে থাকবে। তখন আমরা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস নাগাদ বুস্টার ডোজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। তখন ঐ আমাদের সিদ্ধান্ত হবে বুস্টার ডোজ দেব কি না, আর দিলে কাদেরকে দেব।

‘কোমরবিডিটি থাকাদের বুস্টার ডোজ নিয়ে মত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদেরও’

যুক্তরাজ্যের গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, ছয় মাসের মধ্যে তা দুর্বল হতে শুরু করে। আর সেজন্যই বুস্টার ডোজের পক্ষে সুপারিশ করছেন গবেষকরা।

গত আগস্টে ব্রিটেনের জো কোভিড স্টাডিতে দেখা যায়, ফাইজারের টিকার দুটি ডোজ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রে সুরক্ষা দিলেও ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে তা ৭৪ শতাংশে নেমে আসে।

আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে কার্যকারিতা ৭৭ শতাংশ থেকে নেমে আসে ৬৭ শতাংশে।

সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, টিকা নেওয়ার পর যাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে অনেক আগে টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা নতুন টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি। একে টিকার প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসার প্রমাণ বলে মনে করছেন গবেষকরা।

ব্রিটিশ এপিডেমিওলজিস্ট নেইল ফার্গুসন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে। … আর এ কারণেই বুস্টার ডোজ এত গুরুত্বপূর্ণ।’

যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলেছে, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যাদের জনসন অ্যান্ড জনসনের কোভিড টিকা নেওয়ার পর দুই মাস পার হয়ে গেছে, তারাই বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন।

আর ফাইজার বা মর্ডানার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও, তাদের মধ্যে যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং প্রাপ্তবস্ক যাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অন্য কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা বা দুরারোগ্য ব্যাধি রয়েছে, তারা নিতে পারবেন বুস্টার ডোজ।

প্রাপ্তবয়স্ককে বুস্টার ডোজ দেবে যুক্তরাজ্য

করোনার নতুন রূপান্তরিত ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাতে ১৮ বছর ও তার অধিক বয়সী সব নাগরিককে করোনা টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। 

করোনার অতি সংক্রামক ধরন ডেল্টার প্রকোপ থেকে সুরক্ষার জন্য এতদিন কেবল চল্লিশোর্ধ নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দিয়ে আসছিল যুক্তরাজ্য। কিন্তু সম্প্রতি করোনার আর একটি রূপান্তরিত ধরন শনাক্ত হওয়ার পর সেই নীতিতে পরিবর্তন আনল ব্রিটেনের সরকার। দেশটিতে বর্তমানে বসবাসরত ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ১ কোটি ৯০ লাখ।

করোনা টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ হিসেবে ফাইজার ও মডার্না টিকা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার দুই ডোজ নিয়েছিলেন, তাদেরকেও বুস্টার হিসেবে ফাইজার বা মডার্নার ডোজ দিচ্ছে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক কম এবং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি, তাদের জন্য আগেই তিন ডোজ করোনা টিকা বাধ্যতামূলক করেছিল যুক্তরাজ্য সরকার।

টিকা পেয়েছেন কত মানুষ

গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে টিকা গ্রহীতার সংখ্যা নয় কোটি ৬৯ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা ছয় কোটি দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৯ জন। এছাড়া দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা তিন কোটি ৬৬ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৬ জন।

২৯ নভেম্বর দেশে মোট নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাত কোটি ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৪৩৯ জন। তাদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সাত কোটি দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩৯২ জন ও পাসপোর্টের মাধ্যমে এক কোটি ৫৬ হাজার ৪৭ জন নিবন্ধন করেন।

টিআই/জেডএস