বাক-শ্রবণশক্তি ফিরে পাওয়া ২১৫ শিশুর গল্প
কানে শুনতে ও কথা বলতে না পারা শিশুদের অনেকটা অন্য চোখে দেখে সমাজের অনেক মানুষ। অনেক পরিবার থেকেও তাদের অভিশাপস্বরূপ দেখা হয়। অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ভেসে বাঁচতে হয় এই শিশুগুলোকে। সন্তানের এই অক্ষমতার (সমাজে কথিত) গ্লানি অনেক সময় বিষাদময় করে তুলে গর্ভধারিণী মায়ের জীবনকেও। শুনতে হয় অপয়া, পাপীসহ নানা কুরুচিপূর্ণ কথা।
তবে, আধুনিক বিজ্ঞানের স্পর্শে এ চিত্র এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট নামক অত্যাধুনিক ডিভাইসের মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারছে শিশুরা। কানে শুনতে না পাওয়া এসব অসহায় শিশুর জন্য বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর অন্যতম বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট। হাসপাতালটিতে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ২১৫ শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। তাদের প্রত্যেকেই এখন কথা বলতে পারছে, এমনকি কানেও শুনছে।
কুমিল্লা থেকে হাসপাতালটিতে এসে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করে বাক-শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়েছে পাঁচ বছর বয়সী শিশু নুসরাত জাহান। অনুভূতি জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিশুটির মা বলেন, মেয়ে যখন ডাকলে শুনতে পায়, কথা বলে তখন চোখ দিয়ে এমনিতেই পানি এসে যায়। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখন সে আমাকে মা বলে ডাকে, তার ভাইয়াকে ভাইয়া, বাবাকে স্পষ্টভাবে বাবা বলে ডাকে। এটা আমার কাছে মনে হয় স্বর্গের পাওয়া।
তিনি বলেন, ১৫ মাস বয়স থেকেই বুঝতে পারি নুসরাত কথা বলতে পারছে না। বিষয়টি তার বাবা ও আমার শাশুড়িকে জানাই। তারা বলেন এটা সমস্যা না, অনেক বাচ্চারাই দেরিতে কথা বলে। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারি যে কোনো একটা সমস্যা আছেই। নুসরাতকে ডাকলে মাঝেমধ্যে তাকায়, আবার তাকায় না। তারপর আমি নিজ উদ্যোগেই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই, পরীক্ষা করি।
‘রিপোর্টে সমস্যা দেখা দেওয়ার পর নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে এসে চিকিৎসা শুরু করি। এখানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করার পর থেকে নুসরাত কথা শুনতে পারে এবং ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করেছে’,- যোগ করেন তার মা।
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সরকারকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। এমন উদ্যোগ না থাকলে আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তদের পক্ষে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করানো সম্ভব হতো না। এছাড়াও অধ্যাপক ডা. জাকারিয়া, ডা. আরিফ, তানিয়াসহ এই হাসপাতালে কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের সঙ্গে যারা জড়িত, সবার অসামান্য সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। আমার সন্তান এখন কথা শুনতে পাচ্ছে, আমাকে মা বলছে, এই কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই।
কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট পরবর্তী স্কুলিংয়ের জন্য নিয়মিত হাসপাতালটি আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাফা (২) নামে আরেক শিশু। তার মা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাচ্চার বয়স যখন এক বছর, তখন সে নিচে পড়ে যায়। তখন ভাবলাম মাথায় হয়তো সে প্রচণ্ড চোট পেয়েছে। পরে ব্রেনের একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। পরে তিনি বললেন যে আপনার বাচ্চার আগে কানের চিকিৎসা দরকার, তখনই তাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসি। চিকিৎসকের পরামর্শ মতে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করি।
আওলাদ হোসেন (৪) নামে আরেক শিশুকে গত ছয়মাস ধরে হাসপাতালটিতে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট পরবর্তী স্কুলিং করাতে নিয়ে আসেন মা হালিমা আক্তার। ছেলের চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট পরবর্তী ছয়মাসে আমার বাচ্চার অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে তো একেবারেই কানে শুনতো না, একটু একটু বলতো.. আর এখন সে পুরোপুরিই শুনে এবং অল্প অল্প করে কথা বলতে পারে।
কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট পরবর্তী শিশুদের নিয়ে স্কুলিংয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কথা বলতে শেখানো চিকিৎসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যতদিন পর্যন্ত বাচ্চা পুরোপুরিভাবে কথা বলতে না পারে, ততদিনই তাদের খেলাধুলার মাধ্যমে কথা বলা শিখিয়ে থাকেন হাসপাতালটিতে কর্মরত ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সরা। তাদের মধ্যে অন্যতম সিনিয়র স্টাফ নার্স তানিয়া আক্তার। গত তিন বছর ধরে তিনি বাচ্চাদের কথা বলা শেখানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন।
তানিয়া আক্তার বলেন, এই থেরাপিতে একজন বাচ্চার স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে সময় লাগে তিন বছর। আর আধো আধো কথা বলতে সময় লাগে ১৮ মাস। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট পরবর্তী কোনোকিছু শুনতে বা ব্রেনে সে শব্দটা গ্রহণ করতে সময় লাগে চার থেকে সাড়ে চার মাস। আর মুখ থেকে দাদা, মামা, বাবা.. এরকম কিছু বের হতে সময় লাগে ছয় মাসের মতো। আর পুরো বাক্যে কথা বলতে তিন বছর সময় লেগে যাবে।
তিনি আরও বলেন, এটি আসলে অনেক কষ্টের কাজ। একদিনে অপারেশন, টেস্ট হয়ে যায়। কিন্তু তার মুখ থেকে কী কথা একদিনে আসে? আসে না। অনেক সময় মায়েরাই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। এজন্য এখানে চিকিৎসার আগে আমরা শর্ত দেই যে যারা ঢাকার বাইরে থেকে আসবেন, তাদের এক বছর এখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হবে।
জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ, হেড-নেক ও কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. জাকারিয়া সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অপারেশনটি অন্যান্য সাধারণ অপারেশনের মতো নয়। অন্যান্য অপারেশনের ক্ষেত্রে কিছুদিন পর ওই রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যান। কিন্তু কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অপারেশনের রোগীরা আমাদের লাইফ লং পেশেন্ট। যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তাকে কানে শুনতে হলে এই কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইসটি নিয়েই বাঁচতে হবে।
তিনি বলেন, এই অপারেশনের পরে বাচ্চাদের প্রায় এক বছর আমাদের সঙ্গে কাটাতে হয়। আমাদের একটি স্কুল আছে, সেখানে তাদের এবং তাদের মায়েদের পড়াশোনা করতে হয়। যেদিন বাচ্চার কানে আমরা মেশিনটি লাগিয়ে দেই, এর ২১ দিন পরে আমরা সুইচটি চালু করে দেই। সুইচটি চালু করার পর প্রথমবারের মতো বাচ্চার কানে শব্দ পৌঁছায়। তখন সে প্রথমবারের মতো শব্দ জগতে প্রবেশ করে।
অধ্যাপক জাকারিয়া বলেন, একটি বাচ্চা যখন প্রথম বারের মতো শব্দ জগতে প্রবেশ করে, সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু কথা বলতে পারে না। আমরা যদি স্বাভাবিকভাবে কানে শুনতে এমন কোনো বাচ্চাকেও দেখি, জন্মের পরপরই সে কথা বলতে পারে না। প্রায় দেড় থেকে দুই বছর পর সে কথা বলা শুরু করে। তার কারণ হচ্ছে, এই পুরো সময়টা তার ব্রেইন শব্দগুলোকে জমা করে এবং এক পর্যায়ে যখন ব্রেনে তার শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়, তখন সে বলতে শুরু করে।
টিআই/এমএইচএস