‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়।’ ঘুরেফিরে এই প্রবাদবাক্য মনে আসছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রোগীদের। হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত এই হাসপাতালের আশপাশে কোনো সাগর নেই। তবে পাতাল আছে! বলতে গেলে সেটাই ‘শুকিয়ে’ গেছে। পানির স্তর নিচে নেমে হাসপাতালের গভীর নলকূপে হঠাৎ পানির বদলে উঠছে বালু।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) ভোর থেকে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা। 

রোগীদের অভিযোগ, দুদিন ধরে পানি না থাকলেও এখন পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সাময়িকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পেতে পাঁচ থেকে সাত দিনের মতো সময় লাগতে পারে। 

শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) সকালে হাসপাতালটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পানির সংকটের কারণে শৌচাগারের গন্ধে হাসপাতালে ঢোকাই কঠিন। যেসব রোগীরা চিকিৎসাধীন আছেন, তারা নাকমুখ চেপে কোনোরকমে দুর্গন্ধ সহ্য করেই থাকছেন। 

পানির সংকটে ক্ষোভ শুধু রোগীদেরই নয়, চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে নিরাপত্তারক্ষীদের মাঝেও।

হাসপাতালটির সিসিইউতে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, সিসিইউতে প্রতিদিনই দু-তিনজন রোগী মারা যাচ্ছেন। পানির সংকটের কারণে আমরা হাতটা পর্যন্ত ধরতে পারছি না। হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে কিছু খেতেও পারছি না। আপাতত আমাদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং টিস্যুই একমাত্র অবলম্বন।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিন ঢাকা পোস্টে বলেন, আমি এখানে চার-পাঁচ দিন ধরে চিকিৎসাধীন আছি। গত দুই দিন পানির সমস্যার কারণে খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানি না থাকায় শৌচাগারে ঢোকা যাচ্ছে না। পাশ দিয়ে গেলেও নাক মুখ চেপে ধরতে হচ্ছে। যে অবস্থা, মনে হচ্ছে সুস্থ হতে এসে আরো অসুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়া লাগবে। 

টয়লেটের পাশের ওয়ার্ডে থাকা এক রোগীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বাথরুমের গন্ধের কারণে হাসপাতালে টেকা যাচ্ছে না। এভাবে তো হাসপাতালে থাকা যায় না। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে বাথরুমের পানিও বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে।

হাসপাতাল থেকে পানির কোনো ব্যবস্থা বা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুদিন পানি নেই। কর্তৃপক্ষ কোনো খোঁজই নেয়নি। জিজ্ঞেস করলে বলে আরো পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগতে পারে।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ভোর থেকে এই ভোগান্তি শুরু হয়। রোগী ও স্বজনরা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গণপূর্ত অধিদফতরের প্রকৌশলীদের বিষয়টি জানান। প্রকৌশলীরা সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানান, গভীর নলকূপে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পাম্প দিয়ে পানি উঠছে না। এর বদলে বালু উঠছে।

গণপূর্তের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেকটা নেমে গেছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আমাদের যে পাম্পটি আছে, ওটার পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এই কারণে পাম্প থেকে পানির বদলে বালু উঠছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য নতুন করে গভীর নলকূপ খনন শুরু হয়েছে। এই কাজ শেষ করতে আরও পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগবে।

এই বিষয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পানির সমস্যা সমাধানে আমরা ওয়াসার সাথে যোগাযোগ করেছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পানি চলে আসবে। আপাতত পাশের একটা বিল্ডিং থেকে পানি এনে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো চালাচ্ছি। ওয়াসা জানিয়েছে, আজকের দিনের মধ্যেই হাসপাতালে আরেকটি বিকল্প পানির লাইন তারা স্থাপন করে দেবে। আশা করি, আজকের মধ্যেই পানির সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। 

পানির সংকটের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিডব্লিউডি (গণপূর্ত অধিদফতর) বলছে, বৃহস্পতিবার থেকে সকাল থেকে হঠাৎ করেই ডিপ-টিউবওয়েল থেকে পানি উঠছে না, বালু উঠছে। তার মানে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

পরিচালক বলেন, এমন সময়ে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে- এমনটা আশংকা করে আমরা একমাস আগেই পিডব্লিউডির সাথে মিটিং করে বিষয়টা বলেছিলাম। তারপর তারা হাসপাতালটিতে এর চেয়েও বেশি গভীর আরেকটি ডিপ-টিউবওয়েল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

রোগীদের ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে পরিচালক বলেন, গতকাল থেকে পানি না থাকায় সাধারণ মানুষ অনেক কষ্ট করছে, আমি তাদের সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছি। তারা বাইরে থেকে কিনে এনে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথেই দেখছি। আজকের দিনটা একটু ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি।

টিআই/এইচকে/জেএস