বাংলাদেশের প্রবীণদের (৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব) প্রতি পাঁচজনের চারজনই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) ও বিষণ্নতার মতো অসংক্রামক রোগে ভুগছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ২০২১’ উপলক্ষে পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় আইসিডিডিআর,বি কর্তৃক আয়োজিত এক অনলাইন ওয়েবিনারে এ গবেষণার ফল উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানী ও ইনিশিয়েটিভ ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেসের প্রধান ড. আলিয়া নাহিদ।

দেশব্যাপী পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবীণদের প্রতি দুইজনের মধ্যে একজন দুই বা তার অধিক অসংক্রামক রোগে ভুগছেন। এছাড়া প্রবীণ পুরুষদের তুলনায় (৩৭ শতাংশ) প্রবীণ নারীদের (৫৪ শতাংশ) অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের হার অনেক বেশি।

এছাড়াও দেখা যায়, গত ছয় মাসে প্রবীণদের প্রতি তিনজনের একজন (৩৫ শতাংশ) নিকটস্থ ওষুধ বিক্রেতার কাছে গেছেন চিকিৎসা সেবার জন্য, ৩৬ শতাংশ গিয়েছেন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে, আর ১৭ শতাংশ সেবা নিয়েছেন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে। প্রবীণদের সর্বশেষ ছয় মাসের স্বাস্থ্যসেবার গড় খরচ ছিল দুই হাজার ৪২৯ টাকা। এই প্রবীণদের ৩০ শতাংশ এখনো নিজেরা আয় করেন, যা থেকে তারা চিকিৎসার খরচ চালান। যারা নিজেরা আয় করেন না, তাদের প্রতি পাঁচজনের চারজন চিকিৎসা খরচের জন্য সন্তানদের আয় কিংবা নিজস্ব সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে ৩২ শতাংশ সরকারি সামাজিক সুরক্ষা ভাতা (বয়স্ক/বিধবা) পেয়ে থাকেন।

গবেষণা দলের প্রধান ড. আলিয়া নাহিদ বলেন, আমরা দেশব্যাপী দুই হাজার ৭৯৫ প্রবীণ ব্যক্তির কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাধিক অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের একটা চিত্র পাই যা বেশ উদ্বেগজনক।

তিনি বলেন, সর্বশেষ আদমশুমারি ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবীণ ছিল সাত দশমিক ৪৮ শতাংশ, যা ২০৪১ সালে দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেজন্য প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাকে তাদেও দোরগোড়ায় নেওয়া উচিত। সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে।

আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ

প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবাকে জোরদার করার জন্য নতুন উদ্ভাবনী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবীণদের সেবায় যুবকদের সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন ড. নাহিদ।

ওয়েবিনারে একটি ভিডিও বার্তায় আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ প্রবীণদের মধ্যে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগ, এবং যেসব রোগ প্রবীণদের মাঝে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে সেসব মোকাবিলা করার জন্য আমাদের আরও গবেষণা এবং সহযোগিতামূলক কাজ করতে হবে।

প্রবীণদের সেবাকে আরও কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে ওয়েবিনারে সুপারিশমালা তুলে ধরেন যুক্তরাজ্যের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো-ইপিডিমিওলজি ও গ্লোবালএইজিংয়ের অধ্যাপক ড. ব্লোসম স্টেফান। প্রবীণদের সেবা আরও উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা প্রমাণভিত্তিক জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রবীণ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে অংশীদারিত্ব তৈরি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার জন্য সুপারিশ করেন তিনি।

নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবাকে আরও কীভাবে উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও যুক্তরাজ্য থেকে গবেষক, চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্যানেল আলোচনায় তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।

 

প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কার্যক্রম এবং এ সেবাকে আরও কীভাবে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়, তা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর কাজ কাজ করছে বলে তিনি জানান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) ও রেসপাইরেটরি মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন কোভিড-১৯ মহামারি সময়ে একাধিক অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল সে বিষয়টি উল্লেখ করেন।

প্যানেল আলোচনায় আরও অংশ নেন নেপাল পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. লোচানা শ্রেষ্ঠা, নেপালের পাটান একাডেমির ইমার্জেন্সি মেডিসিনের প্রভাষক ডা. সুনীল অধিকারী, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথ্ নেটওয়ার্কের ডিরেক্টর অধ্যাপক ট্রুডি লাং। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন নেপালের পাটান একাডেমির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক রাজেশ নাথ গোঙ্গল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো জাহিদ হোসেন ও নেপাল পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ডা. মহেশ মাস্কি।

ওয়েবিনারে অসংক্রামক রোগের গবেষণা ও সমাধানে সাউথ-সাউথ সহযোগিতার ভিত্তিতে গঠিত ‘গ্লোবাল ইনোভেশন হাব ফর মাল্টিমর্বিডিটি’ নামক একটি বৈশ্বিক প্লাটফর্মের উদ্বোধন করেন আইসিডিডিআর,বির হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিস ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর অধ্যাপক ড্যানিয়েল ডি. রিডপ্যাথ।

‘গ্লোবাল ইনোভেশন হাব ফর মাল্টিমর্বিডিটি’ শীর্ষক প্লাটফর্মটি বাংলাদেশের আইসিডিডিআর,বি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেপালের পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন ও পাটান একাডেমি অব হেলথ সায়েন্সের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড্যানিয়েল ডি. রিডপ্যাথ। এতে দেশ ও বিদেশের গবেষক, চিকিৎসক, শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিক, টেলি-স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, যুব সংগঠনের প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা অংশগ্রহণ করেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা প্রবীণ ব্যক্তিদের মাল্টিমর্বিডিটি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি অন্যান্য সেক্টরকেও সম্পৃক্ত করার জন্য সুপারিশ করেন।

‘দ্য গ্লোবাল হেলথ নেটওয়ার্ক এশিয়া’ ও ‘ক্লিনিক্যাল রিসার্চ প্লাটফর্ম বাংলাদেশ’ এই ওয়েবিনারের মূল আয়োজক। ওয়েবিনারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘লিঙ্কিং ইউথ টু দ্য ওয়াইজ ফর ডিজিটাল ইকুইটি অ্যান্ড কেয়ার’।

টিআই/আরএইচ