কাঙ্ক্ষিত টিকার অপেক্ষায় দেশবাসী: ছবি- সংগৃহীত

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে আসছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। টিকা প্রয়োগ পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক করণীয় নিয়ে সতর্কতামূলক বিভিন্ন প্রস্তুতি রেখেছে সরকার। এ নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনও প্রস্তুত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ টিকা প্রয়োগ বিষয়ক এক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশব্যাপী টিকাদান শুরু হওয়ার আগে কিছু স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবককে এই টিকা দেওয়া হবে। এরপর তাদের সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। টিকা ব্যবস্থাপনায় ভুলত্রুটি শনাক্ত করা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানার জন্য এই উদ্যোগ। এরপর দেশব্যাপী টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে।

এতে আরও বলা হয়েছে, টিকাদান কর্মী নিজে টিকা নেওয়ার পর ৫-৭ দিন হয়তো কাজে যোগ দিতে পারবেন না। সেই বিবেচনায় প্রতিটি উপজেলা এবং সিটি করপোরেশনে টিকাদান টিম গঠন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এসব প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম ঢাকা পোস্টকে জানান, আগামী ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যেই আশা করছি দেশে টিকা চলে আসবে। এরপর কিছু স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের এই টিকা দেওয়া হবে এবং সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা বা ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি আছে কিনা তা দেখেই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমরা সারাদেশে টিকাদান শুরু করতে পারব।

তিনি বলেন, যেকোনো টিকার ক্ষেত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। কোভিড টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেলে তার চিকিৎসায় সংশ্লিষ্ট টিকা কেন্দ্রে চিকিৎসক, নার্সসহ মেডিকেল টিম থাকবে। জরুরি জীবনরক্ষাকারী কিটসহ আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।

প্রতিবার টিকা দেওয়ার পর টিকা গ্রহণকারী প্রত্যেককে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেখে দেওয়া হবে। তাকে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষেই বাসায় পাঠানো হবে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম

অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার বলেন, সুষ্ঠুভাবে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে সারাদেশে আমাদের প্রায় ৭ হাজার ৩৪৪টি টিম করা হয়েছে। প্রতিটি টিকাদান কেন্দ্রে সর্বমোট ৬ জন কাজ করবেন। যার মধ্যে ২ জন দক্ষ টিকাদান কর্মী এবং ৪ জন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। শিক্ষাণবিশ চিকিৎসক, নার্স, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো), পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, ল্যাব টেকনোলজিস্ট, মিডওয়াইফস, এনজিও ভ্যাকসিনেটরদের মধ্য থেকে টিকাদান কর্মী নির্বাচন করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে থাকবেন পুলিশ, আনসার ভিডিপি, সমাজকল্যাণকর্মী, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য সমাজকর্মীরা।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গণমাধ্যমকে জানান, শুধু টিকা না, যেকোনো ওষুধের ক্ষেত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে আমার মনে হয় খুবই কম মানুষের ক্ষেত্রে এ আশঙ্কা থাকবে। আমাদের মোবাইল টিম থাকবে, টিকাদান কেন্দ্রে বেসিক ও ওষুধ লাগলে ইমিডিয়েটলি ম্যানেজ করার জন্য ব্যবস্থা থাকবে।

তিনি বলেন, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য উপজেলা কেন্দ্রে যত দূর সম্ভব ব্যবস্থা রাখা হবে। এর ব্যাকআপ হিসেবে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে কমিটি থাকবে।

এই সেই টিকা

টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ঔষধ প্রশাসনের গাইডলাইন
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা প্রয়োগের পর কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে পরবর্তীতে করণীয় শীর্ষক একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করেছে ঔষধ প্রশাসন। গাইডলাইনটি বুধবার অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, যেকোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিষয়টি দেখাশোনার জন্য একটা কমিটি করা হয়েছে। তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন যে এটা কি ভ্যাকসিনের কারণে হলো, না অন্যকোনো কারণে।

টিকা নিলে কোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যে স্থানে টিকা দেওয়া হবে সেই স্থানে ব্যথা হতে পারে। হালকা জ্বর আসতে পারে। মাথাব্যথা করতে পারে। এছাড়া স্বল্প পরিমাণে শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে।’

টিকাদান পরবর্তী বিরূপ ঘটনা বিষয়ক সারভিল্যান্স
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ টিকা প্রয়োগ বিষয়ক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, টিকা দেওয়ার পর নির্দিষ্ট কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। যেমন- ইনজেকশন দেওয়ার স্থানের চারদিকে লালভাব, ফোলাভাব বা ব্যথা হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিকা দেওয়ার পরে প্রথম তিন দিন ক্লান্তি, জ্বর এবং মাথা ব্যথা হতে পারে। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর এই সাধারণ প্রতিক্রিয়াগুলো সাধারণত হালকা ধরনের হয় এবং কয়েকদিনের মধ্যে সেরে যায়। বিদ্যমান টিকাদান পরবর্তী জটিলতা কার্যক্রমকে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিকে পুনঃবিন্যাস করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিভাগীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন পরিকল্পনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যানে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে টিকা দেওয়া হবে ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪৫ জনকে। চট্টগ্রাম বিভাগে দেওয়া হবে ২৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৩ জনকে, রাজশাহী বিভাগে ১৯ লাখ ২৪ হাজার ৯২২ জনকে, রংপুর বিভাগে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯ জনকে, খুলনা বিভাগে দেওয়া হবে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪৬ জনকে, সিলেট বিভাগে দেওয়া হবে ১০ লাখ ৩২ হাজার জনকে এবং বরিশাল বিভাগে আট লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে। তিন রাউন্ডে এ জনগোষ্ঠী টিকা পাবেন।

কোন জেলায় কতজন ভ্যাকসিন পাচ্ছেন
জেলা পর্যায়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় ১২ লাখ ৫৪ হাজার ২০০ জন, ফরিদপুরে এক লাখ ৯৯ হাজার ২০৭ জন, গাজীপুরে তিন লাখ ৫৪ হাজার ৪৬৭ জন, গোপালগঞ্জে এক লাখ ২২ হাজার ৯০ জন, জামালপুরে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৭৪৮ জন, কিশোরগঞ্জে তিন লাখ তিন হাজার ২৩২ জন, মাদারীপুরে এক লাখ ২১ হাজার ৪১৬ জন, মানিকগঞ্জে এক লাখ ৪৫ হাজার ৪৬ জন, মুন্সীগঞ্জে এক লাখ ৫০ হাজার ৫৪৪ জন, নারায়ণগঞ্জে তিন লাখ সাত হাজার ১৩ জন, নরসিংদীতে দুই লাখ ৩১ হাজার ৬৯৫ জন, নেত্রকোনায় দুই লাখ ৩২ হাজার ১৮৪ জন, রাজবাড়ীতে এক লাখ নয় হাজার ৩১৯ জন, শরীয়তপুরে এক লাখ ২০ হাজার ৩৬২ জন, টাঙ্গাইলে তিন লাখ ৭৫ হাজার ৪১৬ জন।

টিকার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

বান্দরবানে ৪০ হাজার ৪৩৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই লাখ ৯৫ হাজার ৭৯৫ জন, চাঁদপুরে দুই লাখ ৫১ হাজার ৫৯২ জন, চট্টগ্রামে সাত লাখ ৯৩ হাজার ১২৯ জন, কুমিল্লায় পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ছয়জন, কক্সবাজারে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৪৬৮ জন, খাগড়াছড়িতে ৬৩ হাজার ৯৩০ জন, লক্ষ্মীপুরে এক লাখ ৮০ হাজার ৬৯ জন, নোয়াখালীতে তিন লাখ ২৩ হাজার ৬৬০ জন, রাঙ্গামাটিতে ৬২ হাজার ৬২ জন।

ভোলায় টিকা পাবেন এক লাখ ৮৫ হাজার ২৭ জন, ঝালকাঠিতে ৭১ হাজার ৯০ জন, পটুয়াখালীতে এক লাখ ৫৯ হাজার জন, পিরোজপুরে এক লাখ ১৫ হাজার ৯২৯ জন, বরগুনায় ৯২ হাজার ৯৭০ জন, বরিশালে দুই লাখ ৪২ হাজার ৪২ জন।

বাগেরহাটে এক লাখ ৫৩ হাজার ৭১৩ জন, চুয়াডাঙ্গায় এক লাখ ১৭ হাজার ৫৭০ জন, যশোরে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৮৮৬ জন, ঝিনাইদহে এক লাখ ৮৪ হাজার ৪৫৫ জন, খুলনায় দুই লাখ ৪১ হাজার ৪৪০ জন, কুষ্টিয়ায় দুই লাখ দুই হাজার ৭৩৪ জন, মাগুরায় ৯৫ হাজার ৬৪০ জন, মেহেরপুরে ৬৮ হাজার ২৪৯ জন, নড়াইলে ৭৫ হাজার ১৫১ জন, সাতক্ষীরায় দুই লাখ ছয় হাজার ৮০৮ জন।

বগুড়ায় তিন লাখ ৫৪ হাজার ১৫০ জন, জয়পুরহাটে ৯৫ হাজার ১৫৫ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক লাখ ৭১ হাজার ৫৬৫ জন, নওগাঁয় দুই লাখ ৭০ হাজার ৭৬৮ জন, নাটোরে এক লাখ ৭৭ হাজার ৭২৫ জন, পাবনায় দুই লাখ ৬২ হাজার ৭৫১ জন, রাজশাহীতে দুই লাখ ৭০ হাজার ২৫১ জন, সিরাজগঞ্জে তিন লাখ ২২ হাজার ৫৫৭ জন।

রংপুরে তিন লাখ ২২ জন, দিনাজপুরে তিন লাখ ১১ হাজার ৩৭৭ জন, কুড়িগ্রামে দুই লাখ ১৫ হাজার ৪৮৪ জন, লালমনিরহাটে এক লাখ ৩০ হাজার ৮০৪ জন, গাইবান্ধায় দুই লাখ ৪৭ হাজার ৭৬৪ জন, নীলফামারীতে এক লাখ ৯১ হাজার আটজন, পঞ্চগড়ে এক লাখ দুই হাজার ৮৪৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে এক লাখ ৪৪ হাজার ৭৫২ জন। এছাড়া হবিগঞ্জে দুই লাখ ১৭ হাজার ৫৩৮ জন, মৌলভীবাজারে এক লাখ ৯৯ হাজার ৮৪২ জন, সুনামগঞ্জে দুই লাখ ৫৭ হাজার দুজন, সিলেটে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬১৯ জন।

যেসব স্থানে দেওয়া হবে ভ্যাকসিন
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা/সদর হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুলিশ-বিজিবি হাসপাতাল ও সিএমএইচ, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। এসব জায়গায় প্রথম ধাপের ৫০ লাখ ভ্যাকসিন দিতে সাত হাজার ৩৪৪টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি দলে দুজন সরাসরি ভ্যাকসিন দেবেন এবং বাকি চারজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অন্যান্য কাজ করবেন।

টিআই/জেডএস