তবুও অক্সিজেন নিয়ে শঙ্কা
কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। দিন দিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপে হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা যেন ভেঙে পড়েছে। নেই আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) শয্যা, সাধারণ শয্যা এখন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের (করোনার ভারতীয় ধরন) প্রভাবে বর্তমানে আক্রান্ত রোগীদের প্রধান ভরসা অক্সিজেন। রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের জন্য রোগীদের আর্তনাদ, স্বজনদের চিৎকার আর আহাজারি দাগ কেটেছে সবার মনে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত মা-বাবা বা সন্তানের মুখে মুখ চেপে অক্সিজেন দেওয়ার শেষ চেষ্টা করছেন তার পরমাত্মীয়। একপর্যায়ে অক্সিজেনের লেভেল দ্রুত কমে যাওয়ায় চিকিৎসা দেওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন তারা। হাসপাতালের শয্যার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় তীব্র শ্বাসকষ্টেও মৃত্যুকে বরণ করে নিতে দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
কেন এমন অবস্থা— জানতে চাইলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদুল আজহায় বিধিনিষেধ সীমিত করায় এবং গণপরিবহন খুলে দেওয়ায় সামনের দিনে আমাদের আরও ভয়াল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেহেতু আক্রান্তদের এখন অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে, সেহেতু সংক্রমণ বাড়লে অক্সিজেনের সংকট দেখা দিতে পারে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, দেশে এ মুহূর্তে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। তবে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
ওয়ার্ড মাস্টার বিরক্ত হয়ে তাদের ধমকান এবং হাসপাতালের যেখান থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, সেখানে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন দীর্ঘলাইন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীকে রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ বললেও ওই কর্মচারী তাদের লাইনে দাঁড়াতে বলেন। পৌনে ৫টার দিকে আল-আমিন ও মাইনুল একটি সিলিন্ডার পান। কিন্তু ততক্ষণে রানু বেগমের বাঁচার আশা শেষ, মৃত্যুই যেন পরম শান্তি, তাই মৃত্যুকে বরণ করে নেন তিনি
বরিশাল নগরের পলাশপুরের বাসিন্দা রানু বেগম (৫০)। গত ৩ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। স্বজনরা দ্রুত তাকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নিয়ে আসেন। ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করতে আড়াইটা বেজে যায়। এদিকে, সময় যত যায় রানু বেগমের শ্বাসকষ্ট তত বাড়তে থাকে। করোনা ওয়ার্ডে নেওয়ার পর চিকিৎসক দ্রুত তাকে অক্সিজেন দিতে বলেন। রানু বেগমের ছেলে আল-আমিন ও দেবরের ছেলে মাইনুল দ্রুত অক্সিজেনের জন্য ছুটে যান ইউনিটের দোতলায় ওয়ার্ড মাস্টারের কক্ষে। সেখানে গেলে তিনি পাঠান তিন তলায় নার্সের কক্ষে।
নার্সের কাছে গিয়ে অক্সিজেনের কথা বললে কর্তব্যরত নার্স তাদের পুনরায় ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে যেতে বলেন। আবার তারা ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে ছুটে যান। এবার ওয়ার্ড মাস্টার বিরক্ত হয়ে তাদের ধমকান এবং হাসপাতালের যেখান থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, সেখানে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন দীর্ঘলাইন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীকে রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ বললেও ওই কর্মচারী তাদের লাইনে দাঁড়াতে বলেন। পৌনে ৫টার দিকে আল-আমিন ও মাইনুল একটি সিলিন্ডার পান। কিন্তু ততক্ষণে রানু বেগমের বাঁচার আশা শেষ, মৃত্যুই যেন পরম শান্তি, তাই মৃত্যুকে বরণ করে নেন তিনি।
অক্সিজেন নিয়ে এমন অব্যবস্থাপনা শুধু বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে প্রতিনিয়ত এমন চিত্র চোখে পড়ছে।
সামনের দিনগুলো খুবই কঠিন হবে, অক্সিজেনের সংকটও বাড়বে
সংকটময় এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বিবেচনায় জুলাই মাসে সংক্রমণের যে অবস্থা দেখেছি, এটি যদি আগস্ট মাসেও চলতে থাকে তাহলে আমাদের সামনের দিনগুলো খুবই কঠিন হবে। হাসপাতালগুলোর পক্ষে অধিক চাপ নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। এখন যে পরিমাণ অক্সিজেন রয়েছে সেগুলোতেও সংকট দেখা দেবে। সবমিলিয়ে খুবই খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকার লকডাউনের সময় বাড়িয়েছে, কিছু বিধিনিষেধ শিথিলও করেছে। ঈদের সময় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে লকডাউন শিথিল করে এবং গণপরিবহন খুলে দিয়ে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন ১০ আগস্টের মধ্যে সংক্রমণ যদি কিছুটা কমে আসে, তাহলে হয়তো আমরা রক্ষা পাব। যদি না কমে, আমার মনে হয় হাসপাতালগুলো আর সামাল দিতে পারবে না।’
বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এ মুহূর্তে হয়তোবা আইসিইউর সাপোর্ট বাড়ানো কঠিন হবে, তবে অবশ্যই অক্সিজেনের মজুত বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। যত বেশি পারা যায় মজুত রাখতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, ভারত থেকে অক্সিজেনের কয়েকটা ট্রেন এসেছে, ভালো খবর। এটি যদি নিয়মিত করা যায়, তাহলে আরও ভালো হবে। আমার মনে হয়, যেহেতু ভারতে এখন সংক্রমণ কম, সুতরাং তাদের কাছ থেকে অক্সিজেন পাওয়া সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখন উচিত সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা। বর্তমানে আমাদের রোগীর সংখ্যা কত, অক্সিজেনের চাহিদা কত, আগামী এক মাসে রোগীর সংখ্যা কত হতে পারে, সে অনুযায়ী কী পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে— এসব বিষয় আমাদের আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে।
‘আমাদের একটা প্রাক্কলন করতে হবে যে, সর্বোচ্চ রোগী কত হতে পারে, সেই সংখ্যা অনুযায়ী অক্সিজেনের চাহিদা কেমন হবে, বর্তমানে আমাদের কতটুকু গ্যাপ (ঘাটতি) আছে— এগুলো বের করতে হবে। তারপর সেই গ্যাপ পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
দ্বিতীয়ত, সংক্রমণটা যেন আর না বাড়ে সেজন্য প্রিভেনশনের (প্রতিরোধ) ওপর জোর দিতে হবে— বলেন এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
সংকট নেই, তবুও আছে ভয় : ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের পরিচালক
করোনা চিকিৎসায় দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল। দিন দিন আক্রান্ত রোগীদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে এ হাসপাতাল। আপাতত সেখানে অক্সিজেনের কোনো সংকট না থাকলেও সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণের পরিস্থিতি কী হবে, তা মোকাবিলা করা সম্ভব কি না— এসব নিয়ে বেশ চিন্তিত হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সবমিলিয়ে আমাদের এখানে প্রতিদিন ১০ হাজার লিটার অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। যা অন্য সব হাসপাতালের চেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত আমাদের অক্সিজেনের কোনো সংকট হয়নি বরং আমরা অক্সিজেনের ক্যাপাসিটি (ধারণক্ষমতা) আরও বাড়াচ্ছি। এটি হলে অক্সিজেনের সবচেয়ে বড় কালেকশন (মজুত) থাকবে আমাদের।’
নাসির উদ্দিন বলেন, আমাদের যে ৫০০টি সাধারণ শয্যা আছে, সেগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ছিল না। সেই কাজ প্রায় শেষের পথে। ইতোমধ্যে লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই পুরো ৫০০ শয্যাকে আমরা সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতায় নিয়ে আসব।
‘এখন ২০ হাজার লিটার অক্সিজেনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি ট্যাংক আমাদের এখানে যুক্ত হচ্ছে। এটি যুক্ত হলে হয়তো আগামী চার/পাঁচ দিনের মধ্যে সেটি চালু করতে পারব। তখন আমাদের অক্সিজেনের ক্যাপাসিটি ও রোগীদের শয্যা ক্যাপাসিটি অনেক বেড়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে আমরা ২১২টি আইসিইউ পরিচালনা করছি। অন্যদিকে, কুর্মিটোলার মতো এত বড় একটা হাসপাতালে মাত্র ১০টি আইসিইউ, ঢাকা মেডিকেলে ২০টি, মুগদা মেডিকেলে ১৫টি আইসিইউ রয়েছে। সবমিলিয়ে পুরো ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ কোভিড আইসিইউ রয়েছে, তার তুলনায় অনেক বেশি আইসিইউ পরিচালনা করছি আমরা। এছাড়া আমাদের এখানে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলা রয়েছে ১৩০টির ওপরে। সেখানে ঢাকা শহরের সবগুলো হাসপাতাল মিলিয়ে ১৩০টি হবে কি না— আমার সন্দেহ আছে। তাহলে কী পরিমাণ অক্সিজেনের সাপোর্ট আমাদের দিতে হচ্ছে, সেটি কল্পনা করা যায়!
পরিচালক বলেন, ‘ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে যেসব রোগী আসেন, তাদের অধিকাংশই সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আসেন। প্রায় প্রত্যেক রোগীকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। প্রতিনিয়ত এভাবেই চলতে হচ্ছে আমাদের। এ কারণে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা।
রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেলে করণীয় কী হবে, সেক্ষেত্রে আপনাদের প্রস্তুতি কেমন— ঢাকা পোস্টের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপাতত আমাদের প্রস্তুতি হলো ৫০০টি সাধারণ শয্যাকে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতায় নিয়ে আসা। পাশাপাশি নতুন কিছু আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতোমধ্যে কিছু আইসিইউ বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদা দিয়েছি।
‘তবে, রোগীর সংখ্যা যদি দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যায়, তাহলে তো আমরা সামাল দিতে পারব না। আমাদের যে অক্সিজেন রয়েছে সেগুলো দিয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ রোগীকে সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া অক্সিজেন একটি তরল পদার্থ। বেশিদিন মজুত করেও রাখা যায় না। নিয়মিত যা আসে তা-ই আমরা ব্যবহার করি। পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু মজুত করে রাখি। কিন্তু সংক্রমণ হঠাৎ বেড়ে গেলে বা অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে গেলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না।’
ভারতের অক্সিজেনে স্বস্তি, তবে সরবরাহ দ্বিগুণ করার সুযোগ নেই : লিন্ডে
দেশের সর্ববৃহৎ অক্সিজেন সরবরাহ ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে তারা প্রতিদিন ১৬০ থেকে ১৭০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করে। তাদের মতে, এটিই প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার ফল। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হলেও সংক্রমণ দ্বিগুণ হলে উৎপাদন দ্বিগুণ করার সুযোগ নেই।
প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র রেহনুমা তারান্নুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেশে এ মুহূর্তে প্রতিদিন অক্সিজেনের চাহিদা ২০০ থেকে ২২০ টন। আমরা প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে জোগান দিচ্ছি ১৬০ থেকে ১৭০ টন। এর মধ্যে আমাদের রূপনগরের যে প্ল্যান্ট আছে, সেখান থেকেই ৯০ টনের মতো অক্সিজেন উৎপাদন হয়। বাকি অংশটা আমাদের অন্যান্য যে প্ল্যান্ট আছে, সেগুলো থেকে সংগ্রহ করি। পাশাপাশি আমদানিও করি। সবমিলিয়ে প্রতিদিন ১৬০ থেকে ১৭৯ টন অক্সিজেন আমরা সরবরাহ করি।
‘এছাড়া ভারত থেকে প্রতি সপ্তাহে দুটি ট্রেনে ২০০ টন করে অক্সিজেন আসে। আমরা আপাতত এভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেহেতু দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ, তাই আমরা শিল্প-কলকারখানায় অক্সিজেনের সরবরাহ কমিয়ে হাসপাতালগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। যেন আমরা চলমান সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।’
সংক্রমণের হার যদি দ্বিগুণ হয়, তাহলে কী পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবেন— এমন প্রশ্নের জবাবে লিন্ডে বাংলাদেশের এ মুখপাত্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। নিজেরা উৎপাদন করছি, নতুন করে যোগ হয়েছে ভারত থেকে আশা অক্সিজেন। এটি আমাদের জন্য আশার আলো। তবে রোগীর সংখ্যা যদি দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যায়, তাহলে তো আমরা সে অনুযায়ী অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারব না। সেই সক্ষমতা আমাদের নেই। এখনই আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিচ্ছি। এখন আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বন্ধ রেখে শুধু হাসপাতালগুলোতে দিচ্ছি। হয়তোবা উৎপাদন আরও কিছু বাড়ানো যাবে, তবে সেটি দ্বিগুণ বা তিনগুণ করার সুযোগ নেই।’
রেহনুমা তারান্নুম বলেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমরা একটি অক্সিজেন বুথের ব্যবস্থা করেছি। সেখানে হাসপাতালে ভর্তির মুহূর্তে একসঙ্গে ১০ রোগী অক্সিজেন নিতে পারেন। আমরা দেখেছি, যারা হাসপাতালে আসছেন, তারা খারাপ অবস্থা নিয়েই আসছেন। হাসপাতালে এসে সরাসরি তারা ভর্তি হতে পারছেন না। ভর্তির জন্য সিরিয়ালে থাকতে হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থেকে অনেকে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন। এ কারণে আমরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বুথের ব্যবস্থা করেছি। যাতে সংকটাপন্ন রোগীগুলো হাসপাতালে এসেই চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন নিতে পারেন।
সংকটের মধ্যেও কিছুটা আশার কথা শোনান লিন্ডে বাংলাদেশের মুখপাত্র রেহনুমা তারান্নুম। তিনি বলেন, ‘খুলনা মেডিকেলে আমাদের অক্সিজেনের বুথটি অত্যন্ত কার্যকর ফল দিয়েছে। এমন বুথ যদি আমরা ঢাকাসহ সারাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে চালু করতে পারি, তাহলে করোনা চিকিৎসায় একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে। আমরা আপাতত খুলনা মেডিকেল কলেজে এটি শুরু করেছি। সংক্রমণ যদি আরও বেড়ে যায়, তাহলে হয়তো আমরা নতুন করে আরও কিছু অক্সিজেন বুথ স্থাপনের উদ্যোগ নেব। আশা করি অক্সিজেনের কোনো সংকট হবে না।’
অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে ৩০ ভাগ, বেসরকারিতেই ভরসা
করোনা পরিস্থিতিতে দেশে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে জরুরি মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। সেই চাহিদা মেটাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপরই ভরসা সরকারের। সংকট মোকাবিলায় সরকারিভাবে অক্সিজেন উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ফল পেতে সময় লাগবে বহুদিন। এ অবস্থায় আমদানিকারকদেরই সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে সব ধরনের সহযোগিতা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দেশে অক্সিজেনের চাহিদা একেক সময় একেক রকম। রোগী বাড়লে চাহিদা বাড়ে। কম থাকলে চাহিদাও কমে। এর আগে দেশে অক্সিজেনের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ২০০ থেকে ২২০ টনের মধ্যে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে অক্সিজেনের চাহিদা কী পরিমাণে দাঁড়াবে তা এখনও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না তারা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত সোমবার পর্যন্ত আমাদের অক্সিজেনের চাহিদা ছিল দৈনিক ২০০ থেকে ২২০ টন। এর মধ্যে আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা দেয় ৯০ টন, লিন্ডে বাংলাদেশ দেয় ১১০ টনের মতো। প্রতিষ্ঠান দুটি নিজেরা উৎপাদনের পাশাপাশি ভারত থেকেও অক্সিজেন আমদানি করে।
তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে যদি রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়, তাহলে তো তারা দ্বিগুণ বা তিনগুণ অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে আমাদের সত্যিই সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে কোনোভাবেই অক্সিজেনের ঘাটতি না হয়।’
ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘একটা সময় আমরা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করতাম মাত্র ৯০ টন। তখন অক্সিজেনের চাহিদাও ছিল ওরকম। সেখানে এ মুহূর্তে আমরা ২০০ টনের ওপরে অক্সিজেন সরবরাহ করছি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে আমরা এ অবস্থায় আসতে পেরেছি। ভারত থেকে অক্সিজেনের আমদানি যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে হয়তোবা আমাদের সরবরাহ কিছুটা বাড়তে পারে।’
সরকারিভাবে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে বা উৎপাদনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে অক্সিজেন উৎপাদনের চেষ্টা আমাদের আছে। অক্সিজেন জেনারেটর দিয়ে উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে তিনটি অক্সিজেন জেনারেটর কেনা হয়েছে। এগুলো আমরা তিনটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট আরও কিছু মেশিন আসতে বাকি। সেগুলো এলে ইন্সটল করে কাজ শুরু হবে। সবমিলিয়ে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।’
‘পর্যায়ক্রমে এগুলো চালুর পর আরও ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর কেনা হবে। যেসব হাসপাতালে করোনার রোগীর সংখ্যা বেশি, সেগুলোতে জেনারেটরগুলো সরবরাহ করা হবে’— যোগ করেন তিনি।
৮৩টি হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের আগে সারাদেশে মোট ২২টি হাসপাতালে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক (ভিআইই) ছিল। ২০২০ সালে আরও পাঁচটি হাসপাতালে এ ট্যাংক স্থাপন করা হয়। ফলে মোট ২৭টি হাসপাতাল ভিআইই ব্যবস্থার অধীনে আসে।
পরবর্তীতে করোনা রোগীদের হাই ফ্লো অক্সিজেনের প্রয়োজন মেটাতে সেন্ট্রাল গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ৮৩টি হাসপাতালে ট্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। গত মে মাস পর্যন্ত ৩০টি হাসপাতালে এটি বসানো হয়েছে। প্রতিটি ট্যাংকের জন্য আকারভেদে তিন থেকে সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া ইউনিসেফের সহযোগিতায় আরও ৩০টি হাসপাতালে গ্যাস পাইপলাইন ও অক্সিজেন ট্যাংক বসানোর কাজ শুরু হয়েছে।
টিআই/এমএআর/এইচকে