হোম আইসোলেশনে নজর নেই, নিয়ন্ত্রণহীন করোনা
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। শনাক্ত ও মৃত্যুতে প্রতিনিয়তই নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগ করোনা নিয়ন্ত্রণে কাগজে-কলমে নানা পদক্ষেপের কথা বললেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি তারা দেখাতে পারছে না।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তারা বলছেন, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঠিক মতো আইসোলেশন (করোনা আক্রান্ত হলে সুস্থ মানুষ থেকে বিচ্ছন্ন রাখা) করা হচ্ছে না। বিশেষত হোম আইসোলেশনে যারা থাকছেন, তারাও নিজেদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করছে। এতে তাদের সংস্পর্শে এসে অন্যরাও নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। আইসোলেশনে স্বাস্থ্যবিভাগের নজরদারি না থাকায় সংক্রমণ পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
বিজ্ঞাপন
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৫ জনে। এ সময় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১২ হাজার ১৪৮ জন। এতে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৯২২ জনে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সপ্তাহে (বৃহস্পতিবার) মৌলভীবাজারে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের সহায়তায় মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি (ব্যাংকের গ্রাহক) নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলেন। কাজ শেষ হলে ব্যবস্থাপকের কাছে দোয়া চেয়ে ওই ব্যক্তি (গ্রাহক) বলেন, ‘স্যার খাস দিলে দোয়া কইরেন, আমি করোনা পজিটিভ। হাসপাতালে ভর্তি হতে যাচ্ছি।’ গ্রাহকের মুখে এমন কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন ব্যবস্থাপক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাঙ্গাইলের একটি ফায়ার সার্ভিস দফতরের কর্মরত এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, করোনা উপসর্গ নিয়ে তিনি গত এক সপ্তাহ ধরে ডিউটি করছেন। পাশাপাশি জ্বর, গলা ব্যাথার ওষুধ খাওয়াসহ নাকের ঘ্রাণ ফেরাতে ঘরোয়া চিকিৎসা নিচ্ছেন। এমতাবস্থায় নমুনা পরীক্ষা করাতে চাইলে অফিস থেকে জানানো হয় পজিটিভ হলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ঢাকার পূর্বাচলের কোয়ারেন্টিইন সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ফায়ার সার্ভিস অধিদফতর থেকে সব স্টাফদের করোনা পরীক্ষার নির্দেশনা আসবে। সুরক্ষিত স্থানে থেকেও কর্মীরা কেন করোনা পজেটিভ হলো, সে ব্যাপারে অধিদফতরের কাছে জবাবদিহী করতে হবে। এ ভয়ে সংশ্লিষ্টরা তাকে পরীক্ষা করাতে অনুৎসাহিত করেন। অথচ নমুনা পরীক্ষা করালে তার নিশ্চিত করোনা শনাক্ত হবে বলে নিজেই স্বীকার করেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনা দেখা দেওয়ার পর থেকে তারা বারবার শনাক্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশন করা ও উপসর্গ সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকার কখনোই সর্বশক্তি দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণের এই মূল জায়গায় কাজ করেনি। বিভিন্ন সময় বিধিনিষেধ সংক্রান্ত জারিকরা প্রজ্ঞাপনে অনেক কিছু বললেও কোয়ারেন্টাইন (সঙ্গনিরোধ) ও আইসোলেশেনের মত মূল কাজে বরাবরই উপেক্ষা করে আসছে। হাসপাতাল বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিছু কাজ ছাড়া কিছুই হচ্ছে না। ফলে করোনা পজিটিভ ব্যক্তি উদাসীন চলা-ফেরায় সংক্রমণ পরবর্তী মৃত্যুও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, আইলোশেন হলো যার রোগ দেখা দিয়েছে বা পরীক্ষা করে করোনা ধরা পরেছে তাকে বিছিন্ন করে রাখা। এক্ষেত্রে পিরিয়ড অব কমিউনিকেবিলিটি বা যতদিন সে পর্যন্ত সে রোগ না ছাড়ায় ততদিন। আর কোয়ারেন্টাইন হলো কেউ আক্রান্ত হয়েছে, অথবা আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছে কিন্তু লক্ষণ দেখা যায়নি, এমন পরিস্থিতিতে নূন্যতম ১৪ দিন তাকে সঙ্গনিরোধ করে রাখা। এ জন্য প্রত্যেক রোগীকেই আইসোলেশন করা দরকার। না করলেও ওই রোগী আরও কয়েকজনের মধ্যে ছড়াবে।
তিনি বলেন, সন্দেহভাজনদের শনাক্ত হলেই প্রাতিষ্ঠানিক বা হোম আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ জন্য কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিশ্বের অনেক দেশ এ পদ্ধতি কঠোরভাবে অনুসরণ করেছে। না হলে নন-আইসোলেটদের মাধ্যমে ঈদের পরে সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের মতো মৌলিক জায়গায় গুরুত্ব না দেওয়ায় লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ কোনটাতেই পরিপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। চলতি মাসের প্রথম দিকেও দৈনিক শনাক্তের হার ২৬ শতাংশে ছিল। অথচ টানা দুই সপ্তাহ কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েও শনাক্ত প্রায় ৩২ শতাংশে উঠেছে। এর কারণ লকডাউনের সঙ্গে রোগী শনাক্ত, সংক্রণের উৎস শনাক্ত, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন সেভাবে হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আইসোলেশন কোয়ারেন্টাইনের কাজগুলো করতে গিয়ে সরকার শুধু প্রশাসন নির্ভর হচ্ছে। অথচ জনসম্পৃক্ততা ছাড়া এটি করা যায় না। তবে অনেক পরে হলেও ওয়ার্ড, ইউনিয়ন কমিটি হয়েছে। কমিটির উচিৎ বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে সর্বত্র র্যাপিড এন্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত ও আইসোলেশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। এ জন্য অঞ্চলভেদে কৌশল অবলম্বন করে কাজ করা। না হলে ভাইরাসটি সুপার স্প্রেড আকারে ছড়িয়ে পড়বে।
এই বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও এর জবাব দেওয়া হয়নি।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ক দৈনন্দিন বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে ১৫ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সকাল ৮টা থেকে ১৬ জুলাই (শুক্রবার) সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৪ হাজার ২১৬ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে। এ সময় ছাড় পেয়েছেন ২ হাজার ১২৩ জন। আর দেশে করোনা সন্দেহে এ পর্যন্ত আইসোলেশনে যুক্ত হয়েছেন ২ লাখ ৪০ হাজার ২২৬ জন, ছাড় পেয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৯ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছে ৭৪ হাজার ৬২৭ জন।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছেন ১২ হাজার ১৪৮ জন। এ পর্যন্ত পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৯২২ জন। আর আক্রান্ত হয়ে গত একদিনে ১৮৭ জনসহ এখন পর্যন্ত মোট ১৭ হাজার ৪৬৫ জন মারা গেছেন।
টিআইি/এসএম