বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত ‘অবান্তর’, রেকর্ড ছাড়াবে সংক্রমণ
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। প্রতিদিনই হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃতের নতুন নতুন রেকর্ড। এদিকে আসন্ন ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে বিধিনিষেধ ৮ দিনের জন্য শিথিল করেছে সরকার। এমন সিদ্ধান্তকে ‘অবান্তর’ বলছে সরকারের করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
তাদের আশঙ্কা, ঈদকে কেন্দ্র করে করোনা পরিস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে পারে। দেশের সংক্রমণ আগের সব রেকর্ড ছাড়াতে পারে।
পরামর্শক কমিটির সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বিধিনিষেধ শিথিলের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে আগামী ১৪ জুলাই (বুধবার) মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত সব বিধিনিষেধ শিথিল করেছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিধিনিষেধ শিথিলে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে কারিগরি কমিটি উদ্বিগ্ন। এ সিদ্ধান্ত আমাদের পরামর্শের উল্টো। এর ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।’
মোহাম্মদ সহিদুল্লা আরও বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম কঠোর বিধিনিষেধটা যদি আরও কিছুদিন চলত, তাহলে আমাদের অবাধ মেলামেশাটা হতো না। আর হলেও সেটা একদমই সীমিত পরিসরে হতো। আমরা তো এ ভাইরাসটি সম্পর্কে জানি, অবাধ মেলামেশা হলেই এটি একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। সেক্ষেত্রে যেহেতু বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে, সেহেতু সংক্রমণ নিয়ে আমাদের ভয় থাকছে।’
এদিকে, বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্তকে ‘অবাস্তব’ উল্লেখ করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘টেকনিক্যাল কমিটি লকডাউন পুরোপুরিভাবে চালিয়ে নেওয়ার কথাই বলেছিল। কমিটি কখনোই সরকারের এরকম অবাস্তব সিদ্ধান্তের কথা বলেনি। দুই দিন লকডাউন থাকবে, আবার ছুটি, পরে আবার অফিস খুলে দেওয়া হবে… এইসব পরামর্শ আমরা কখনোই দিইনি।’
তিনি বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের আসলে কী চিন্তা, সেগুলো আমাদের বলে না। এমনকি বিধিনিষেধ শিথিলের ব্যাপারেও আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। এখন সরকারের এই সিদ্ধান্তে কি সংক্রমণ কমবে? নাকি মৃত্যু কমবে? কোনটাই কমবে না, এটা সবাই জানে। এটা সাধারণ একজন রিকশাওয়ালাও চোখ বুজে বলতে পারবে। এখন আসলে কর্তৃপক্ষের মাথায় কী ঘুরছে, এখন কী, এরপর কী, তারপরে কী… আমাদের সঙ্গে কোনো বিষয়েই পরামর্শ করা হচ্ছে না।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ পরিস্থিতিতে বিদ্যমান লকডাউন তুলে দিলে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ও জনস্বাস্থ্যবিদ ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ’দৈনিক মৃত্যুহারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আজ (১২ জুলাইয়ের তথ্যানুযায়ী) চতুর্থ। আজ সর্বোচ্চ শনাক্তও হয়েছে। এর মধ্যেই ১৫ তারিখ থেকে লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়’
তিনি আরও বলেন, ‘’ভারতে যখন প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার জন মারা যাচ্ছিলেন, তখন আমরা বলেছিলাম, ‘ভারতে কী ভয়ংকর অবস্থা’! কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা ভারতের চেয়ে সাড়ে আট গুণ কম। সেই হিসেবে বাংলাদেশের ২ শতাধিক মৃত্যু, ভারতের প্রায় ২০০০ জন মৃত্যুর সমান। তাহলে কি বাংলাদেশে এখন ভয়াবহ অবস্থা নয়? অবশ্যই ভয়াবহ অবস্থা। এর ভেতরে লকডাউন তুলে দিলে গোটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’
এদিকে, দেশে করোনা সংক্রমণের এ পরিস্থিতিতে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরও। শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালে আইসিইউ শয্যাসহ কোনো সাধারণ শয্যাও খালি পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন।
গত রোববার (১১ জুলাই) দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য বুলেটিনে তিনি বলেন, গত মাসে (জুন) সারাদেশে সংক্রমণের হার অনেক বেশি ছিল। জুন মাসে এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন সংক্রমিত হয়েছেন। জুলাইয়ের প্রথম ১০ দিনে প্রায় এক লাখ রোগীকে সংক্রমিত হতে দেখেছি। আমরা যেভাবে সংক্রমিত হচ্ছি, হাসপাতালে রোগীর চাপ যদি বাড়তেই থাকে, আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে হাসপাতালের শয্যা আর খালি থাকবে না।
ওই বুলেটিনে রোবেদ আমিন আরও বলেন, কোভিড-১৯ এর যে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন আছে, তার মাধ্যমে মৃত্যু শুধু বয়স্ক মানুষের হচ্ছে না, তরুণদেরও হচ্ছে। বিভাগ অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে আমরা দেখেছি, সব জেলাতেই কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে এবং সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে। সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে।
টিআই/এসএম/জেএস