স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন ভিন্ন ৪৮টি আদেশে সারাদেশে প্রায় এক হাজার ৩০০ চিকিৎসককে গণবদলির ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। সংগঠনটি দাবি করেছে, করোনা মোকাবিলায় যখনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার বিষয়ে সর্বমহলে আলোচিত হয়, তখনই ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো আড়াল করার জন্য সুকৌশলে চিকিৎসকদের ঘাড়ে সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। চিকিৎসকদের এই গণবদলি বাতিলের পাশাপাশি ভ্রান্ত আদেশ জারিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিচারেরও দাবি জানিয়েছে বিএমএ।

শুক্রবার (৯ জুলাই) বিকেলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে এ দাবি জানানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী।

চিঠিতে বলা হয়, দেশে করোনা মোকাবিলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে একশ ষাট জনেরও অধিক চিকিৎসকসহ অনেক সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসকদের এখনও প্রণোদনা/সম্মানী যথাযথভাবে দেওয়া হয়নি।

পাঠকদের জন্য বিএমএ’র চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

বরাবর,
জনাব জাহিদ মালেক এমপি
মাননীয় মন্ত্রী
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বিষয়ঃ সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসকদের গণহারে বদলি প্রসঙ্গে

জনাব,
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন ভিন্ন আদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে প্রায় এক হাজার তিনশ চিকিৎসকের গণবদলি আমাদের বিস্মিত করেছে। চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের বিগত ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় নিম্ন লিখিত বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়েছে।

সবাই অবগত আছে যে করোনা মহামারি প্রকোপের শুরুতে এ দেশের চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই, মাস্ক ইত্যাদি বিষয়ে নানা কেলেঙ্কারি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ভুল ত্রুটির কারণে সারাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনায় সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম। বিগত প্রায় পনের মাসেরও অধিক সময় থেকে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরলসভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করার কারণে মহামারি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইত্যবসরে আমরা হারিয়েছি আমাদের একশ ষাট জনেরও অধিক চিকিৎসকসহ অনেক সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে পরিলক্ষিত হয়েছে যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুষ্পষ্ট নির্দেশনার পরও আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসকদের প্রণোদনা/সম্মানী যথাযথভাবে প্রদান করা হয়নি।

কয়েকজন সরকারি চিকিৎসককে প্রণোদনা প্রদান করা হলেও বেসরকারি চিকিৎসকদের কিছুই দেওয়া হয়নি। অথচ করোনা রোগের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বেসরকারি চিকিৎসকদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। এমনকি চিকিৎসক ও সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। যার ফলে চিকিৎসক কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের রোগে আক্রান্তের হার অনেকাংশে বেড়ে যায়। কোনো কোনো চিকিৎসক দ্বিতীয়বার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দীর্ঘদিনের বিরতিহীন সেবা ও তাদের কারণে পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি নিয়ে দেশের সব চিকিৎসক চূড়ান্ত মানসিক যন্ত্রণায় সময় পার করছেন। অধিকন্তু ইদানিং ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মরার ওপর খাড়ার ঘা রূপে আবির্ভূত হয়েছে।

এতকিছুর পরও চিকিৎসকরা ক্লান্তিহীনভাবে মহামারিসহ সব চিকিৎসায় নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন। অকস্মাৎ বিগত দুই দিনে আপনার মন্ত্রণালয় থেকে চিকিৎসকদের গণবদলির আদেশ সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এই আদেশের ফলে মন্ত্রণালয়ের অস্থিরতা, বেহালদশা ও অযোগ্যতা প্রকট আকারে পরিস্ফুটিত হয়েছে। যে মন্ত্রণালয় একটি সুনির্দিষ্ট ও কল্যাণকামী আদেশ করতে পারে না, সেই মন্ত্রণালয় সারা দেশে কীভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করবে।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যখনই মহামারি চিকিৎসায় মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার বিষয়ে সর্বমহলে আলোচিত হয়, তখনই ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো আড়াল করার জন্য সুকৌশলে মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের ঘাড়ে সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

এই আদেশে মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকদেরও বদলি করে হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। যেসব চিকিৎসক দীর্ঘদিন রোগী দেখেন না, বিশেষ করে বেসিক সাবজেক্ট ও রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক, তাদেরও করোনা রোগী দেখার জন্য বদলি করা হয়েছে। এমনকি দন্ত চিকিৎসক, নিউরো সার্জনসহ অন্যান্য বিশেষায়িত বিভাগের বিশেষজ্ঞদের বদলি করা হয়েছে, তারা করোনা রোগী দেখায় কীভাবে ভূমিকা রাখবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।

মাইক্রোবায়োলজী বিভাগ কিংবা করোনা ল্যাবে কর্মরত চিকিৎসকদের বদলি করে দেওয়ায় আরটিপিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

আমাদের জানামতে মহামারি নিয়ন্ত্রণ একটি সমন্বিত কার্যক্রম, যেখানে আবশ্যিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অপরিহার্য। সেখানে শুধু আমলাতন্ত্র এতটা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে যে তারা যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরে যে উপনিবেশিক আমলাতন্ত্র বিরাজ করছে তারই প্রতিফলন ভিন্ন ক্যাডার দিয়ে দিকভ্রান্তের মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা। যখন সারাদেশে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনবরত বেড়েই চলেছে এবং যখন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনরাত পরিশ্রম করে কাজ করে যাচ্ছেন, তখন এ রকম একটি হাস্যকর ও অসাড় আদেশের মাধ্যমে চিকিৎসকদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করা ও সরকারকে বিভ্রান্ত করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা একটি অসাধু চক্র নিরন্তর অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।

এই আদেশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের সুকৌশলে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চায়। বিএমএ অনতিবিলম্বে এই বিতর্কিত আদেশ বাতিল করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং ভ্রান্ত আদেশ জারিতে জড়িত রাষ্ট্র, জনগণ ও সরকারের স্বার্থ বিরোধী কর্মকর্তাদের বিচারের দাবি করছে। বিএমএর সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন চিকিৎসক নিয়োগ কিংবা চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করার অনুরোধ করছি।

অনতিবিলম্বে এই বিতর্কিত আদেশ বাতিল করা না হলে বিএমএ এই আদেশ বাতিলের প্রয়োজনে যেকোনো কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। বিষয়টি আপনার সদয় অবগতি ও দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হলো।

ধন্যবাদসহ-

ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন,
সভাপতি, 
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন।

ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী
মহাসচিব,
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন।

টিআই/এসএসএইচ