করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জীবন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন চিকিৎসকরা। এই অবস্থায় চিকিৎসকদের গণবদলি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অস্থিরতার মুখে ঠেলে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ। 

তিনি বলেন, দেশে সংকটকালীন এই আদেশ আমলাতান্ত্রিক মূর্খতার আরেকটি উদাহরণ মাত্র নাকি চিকিৎসকদের হতাশায় নিমজ্জিত করে অস্থিরতা সৃষ্টির ধারাপাত?

মঙ্গলবার (৬ জুলাই) সারাদেশে হঠাৎ চিকিৎসকদের গণবদলি প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি এসব কথা বলেন। একইসঙ্গে তিনি আদেশের প্রেক্ষিতে ১০টি প্রশ্ন ছুড়ে দেন।

এম এ আজিজ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবন ও জীবিকার সমন্বয় নিশ্চিত করে জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রেখেই দেশকে করোনা মোকাবিলায় সামনে থেকে সফল নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছেন। তারই নেতৃত্বে করোনার শুরু থেকেই দেশের চিকিৎসকরা সবচেয়ে সম্মুখসারির অগ্রজ যোদ্ধা হিসাবে করোনার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই করছে। প্রধানমন্ত্রী যখনই চিকিৎসকদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন দেশের চিকিৎসকরা সে নির্দেশনা শিরোধার্য জ্ঞানে যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু এই করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় আমলার চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও কর্মকাণ্ড পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকেই বারবার প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, গতকাল আকস্মিকভাবে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের কয়েকশ শিক্ষক-চিকিৎসকের গণবদলির আদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর বিরাজিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে অস্থিরতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই আদেশ আমলাতান্ত্রিক মূর্খতার আরেকটি উদাহরণ মাত্র নাকি চিকিৎসকদের হতাশায় নিমজ্জিত করে অস্থিরতা সৃষ্টির ধারাপাত?

আদেশের প্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখার অনুরোধ জানান। সেগুলো হলো-

১. স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ আদেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন এমন তথ্য মিলছে না কোথাও, আমলারা বিভিন্ন সময়ের মতো মন্ত্রীকে বিব্রত করার আরেকটি অপকৌশল গ্রহণ করেছেন বলেই সবার ধারণা। এ আদেশ জারির আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকদ্বয়, পরিচালক (প্রশাসন), বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এমনকি সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন, যারা ১৫ মাস ধরে কোভিড ব্যবস্থাপনায় সফলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের সঙ্গে কি ন্যূনতম আলোচনা বা সমন্বয় করা হয়েছে? আমার জানা মতে মন্ত্রণালয় তা না করেই তাদের খেয়ালখুশি মতো কোভিড চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নাম করে শয়ে শয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করেছে। কিন্তু বদলিকৃত হাসপাতালে এসব বিশেষজ্ঞের কাজ কী হবে, তা ন্যূনতম বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

বেসিক বিষয়ের শিক্ষকতায় যুক্ত চিকিৎসকরা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে কোভিড রোগীদের কী সেবাদান করবেন? এসব চিকিৎসক প্রায় প্রতিদিন এমনকি রাতেও অনলাইনে ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করছেন কলেজগুলোতে। এ বদলি আদেশের ফলে ছাত্ররাও বঞ্চিত হবেন শিক্ষকদের ক্লাস থেকে। বেসিক বিষয়ের অধ্যাপনার সঙ্গে যেসব চিকিৎসক সম্পৃক্ত তাদের প্রায় সবাই দীর্ঘসময় ধরে রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান থেকে দূরে। তারা হঠাৎ করে কোভিড রোগীদের কী চিকিৎসাসেবা দেবেন সদর হাসপাতাল বা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে?

২. যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি কে, সৈনিকই বা কারা, তা নির্দিষ্ট করা থাকে, এটিই নিয়ম। অথচ এ আদেশে কোনো চিকিৎসকের পদবি উল্লেখ না করেই কোভিড যুদ্ধের রণাঙ্গনে পাঠানো হলো। শুধু নাম ও কোড নং দিয়ে চিহ্নিত করে। যুদ্ধের ময়দানে জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল, লেফটেন্যান্ট, সৈনিকদের কাজের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট করা থাকে। কিন্তু এ আদেশে কোভিড যুদ্ধের ময়দানে প্রেরণকারী চিকিৎসকদের সবাই যেন সৈনিক, জেনারেল-ব্রিগেডিয়ার-কর্নেল-লেফটেন্যান্ট-ক্যাপ্টেন সবাই এক কাতারে। সৈনিকদের নেতৃত্বেই যেন কোভিড যুদ্ধ হবে! আহাম্মক মস্তিষ্ক ব্যতীত এরকম সিদ্ধান্ত পয়দা হতে পারে না।

৩. বদলির আদেশাধীন চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ ৫০ পেরোনো, এ বয়সের চিকিৎসকদের কোভিড রোগীর চিকিৎসা দিতে বাধ্য করা কতোটা বৈজ্ঞানিক? এ সিদ্ধান্ত কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমর্থন করে?

৪. মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীর তুলনায় অন্তত ১০ গুণ নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। বদলির আদেশে বিভিন্ন বিভাগ খালি করে যে হারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে বাধ্য, এর দায়ভার কে নেবে?

৫. বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা না করে পদায়নের ফলে চাহিদা নেই এমন অনেক হাসপাতালেও অহেতুক বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসক পদায়িত করা হয়েছে, যা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। যেমন- চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে শ’খানেক কোভিড রোগী ভর্তি থাকেন। এ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসকদের তেমন কোনো চাহিদা নেই, অথচ এ হাসপাতালে ৬০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে বদলির আদেশ দেয়া হয়েছে।

৬. এ তুঘলকি আদেশে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ, নাক-কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, নিউরোসার্জন, জেনারেল সার্জন, ডেন্টাল সার্জন ইত্যাদি নানা বিশেষায়িত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সদর হাসপাতাল, উপজেলায় বদলি করা হয়েছে। এসব চিকিৎসকের কোভিড রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্র কোথায়? সদ্য বদলিকৃত কোভিড কর্মস্থলে তাদের করণীয়ই বা কি হবে?

৭. কোনো কোনো মেডিকেল কলেজে আরটি-পিসিআর ল্যাবে কর্মরত সব চিকিৎসককে একযোগে বদলি করা হয়েছে। যেমন- চট্টগ্রাম ও রংপুর মেডিকেল কলেজ ল্যাবের প্রায় সবাই বদলি হয়েছেন। এই ল্যাবগুলো এখন পরিচালনা করবেন কে বা কারা, তারও কোনো নির্দেশনা নেই, নাকি ল্যাবগুলো বন্ধ করে টেস্ট যাতে না হয় সে লক্ষ্যেই এ সিদ্ধান্ত?

৮. আমলাদের এ আগ্রাসী আদেশে মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকরাও রেহাই পাননি। ডা. ফেরদৌস আরা বেগম, কোড নং- ৩৯৯১১, সহকারী অধ্যাপক, গাইনি ও অবস বিভাগ, রংপুর মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন আরও আগে। এ আদেশে তিনিও বদলি হয়েছেন! কবরেও স্বস্তি নেই, শান্তি মিলছে না চিকিৎসকদের! ডা. মমতাজ বেগম, কোড নং- ৩২৬৬০, সহকারী অধ্যাপক, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, তিনিও রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে অবসরে গেছেন আরও আগে, এ আদেশে তিনিও বদলি হয়েছেন! অবসরেও নিরাপদ থাকতে পারলেন না তিনি!

৯. কোভিড হাসপাতালগুলোতে চাহিদা রয়েছে আইসিইউতে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং কিছু মেডিকেল অফিসার বা সহকারী সার্জন। চাহিদা ও অগ্রাধিকার সুনির্দিষ্টভাবে চূড়ান্ত না করে নিজেদের মর্জিমাফিক এমন বদলির আদেশ চলমান চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় শুধু সংকটই বাড়াবে, সমাধানের কোনো পথ বাতলে দেবে না।

১০. বদলিকৃত চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ দূরের উপজেলা বা জেলা সদরে। নতুন কর্মস্থলে তারা যাবেন কীভাবে, তাদের বাহন কি? এসব চিকিৎসক নতুন কর্মস্থলে থাকবেন কোথায়? এসব প্রয়োজনীয় বিষয়াবলি বিবেচনায় না নিয়েই এ অপ্রয়োজনীয় আদেশ চিকিৎসকদের হতাশ করবে, অস্থিরতার মুখে ঠেলে দেবে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে।

টিআই/ওএফ