বাংলাদেশ না বাঁচলে ভারতও বাঁচবে না
চলতি মাসেই ভারত থেকে আসছে না করোনাভাইরাসের টিকা। জানুয়ারিতে সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকা আসার কথা থাকলেও সহসাই তা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ভারতের টিকার চাহিদা মেটানোর আগে অন্য দেশকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা না দেওয়ার বিষয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের বক্তব্য এ অনিশ্চয়তা তৈরি করে। যদিও পরবর্তীতে টিকা দেওয়ার বিষয়ে দেশটির সরকার ও সেরাম ইনস্টিটিউট ‘ইতিবাচক’ বক্তব্য দিয়েছে।
ইতোমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ধাপ পার করছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ধাপে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে আরও ৭৮৫ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল সাত হাজার ৭৩৪ জনে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ২০ হাজার ৬৯০।
বিজ্ঞাপন
নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে অবশ্যই তারা (ভারত) আমাদের চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাবে। হয়তো একেবারে কাটায় কাটায় ওই পরিমাণ টিকা নাও আসতে পারে, কিন্তু আমরা অবশ্যই পাব। আমরা আশা করছি, পরিমাণ যাই হোক না কেন, প্রথম চালানটা সময়মতো পাব
ডা. মুশতাক হোসেন, প্রধান উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি, করোনার নতুন স্টেইন (পরিবর্তিত রূপ), ভ্যাকসিনসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকা পোস্ট-এর মুখোমুখি হন বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। ঢাকা পোস্ট-এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
ঢাকা পোস্ট : শুরুতেই করোনার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই…
মুশতাক হোসেন : শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সামনে যেহেতু নতুন করে শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে, সেহেতু সামনের দিনগুলোতে তীব্র আক্রান্তের আশঙ্কা থেকেই যায়। শীতকালে মানুষ ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখে। বন্ধ জায়গায় করোনা বেশি ছড়ায়। শীতের সময় একটি বদ্ধ জায়গায় অনেক মানুষ অবস্থান করবে, ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকিও থাকবে। যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি, রোগী শনাক্ত না করি, আইসোলেশন না করি, তা হলে শীতে সংক্রমণ বাড়বে।
ঢাকা পোস্ট : করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে জানতে চাই। সহসাই কি আসছে কাঙ্ক্ষিত ভ্যাকসিন?
মুশতাক হোসেন : আপনারা জানেন যে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের চুক্তি হয়েছে। যদিও ভ্যাকসিন আসা নিয়ে একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে, তবে আমরা এখনও আশা রাখছি যথাসময়ে ভ্যাকসিন পাব। বাংলাদেশ ছাড়াও মালয়েশিয়া, ব্রাজিলসহ আরও কয়েকটি দেশের ভারতের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। কিন্তু নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে অবশ্যই তারা আমাদের চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাবে। হয়তো একেবারে কাটায় কাটায় ওই পরিমাণ টিকা নাও আসতে পারে, কিন্তু আমরা অবশ্যই পাব। আমরা আশা করছি, পরিমাণ যাই হোক না কেন, প্রথম চালানটা সময়মতো পাব।
ঢাকা পোস্ট : ভারত কি নিজেদের চাহিদা না মিটিয়েই আমাদের ভ্যাকসিন দেবে?
মুশতাক হোসেন : ভারত সরকার তো ভ্যাকসিন না দেওয়ার বিষয়ে এখনও আমাদের কিছু বলেনি। তবে হয়তো পারিমাণে কম-বেশি হতে পারে। তাদের যতটুকু উৎপাদন হবে, সে অনুযায়ী আমাদের দেবে। ভারতের জনগণকে অবশ্যই তারা অগ্রাধিকার দেবে। এছাড়া ভারতের করোনা পরিস্থিতিও ভালো নয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তাদের মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ। তবে ভারতকে এটাও ভাবতে হবে যে, তারা না বাঁচলে যেমন বাংলাদেশ বাঁচবে না, তেমনি বাংলাদেশ না বাঁচলে ভারতও বাঁচবে না। বাংলাদেশে যদি সংক্রমণ চলতে থাকে, ভারত যতই সংক্রমণমুক্ত হোক না কেন, আবার সংক্রমিত হবে। তেমনি বাংলাদেশকে যদি আমরা করোনামুক্ত করে ফেলি আর ভারতে করোনা থাকে, তাহলে আমরা করোনামুক্ত থাকতে পারব না। কাজেই করোনা মোকাবিলায় দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা লাগবেই।
এ মুহূর্তে প্রস্তুতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনা। যারা নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের থেকে যেন ভাইরাসটি নতুন কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া
ডা. মুশতাক হোসেন, প্রধান উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
ঢাকা পোস্ট : সেরাম ছাড়াও অন্য কোনো দেশের সঙ্গে টিকার জন্য আমাদের চেষ্টা চালানো উচিত কি-না?
মুশতাক হোসেন : আমাদের পক্ষ থেকে সেরাম ইনস্টিটিউট ছাড়াও অন্যান্য সূত্র থেকেও টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। মন্ত্রিসভায় আরও বাজেটের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কোভ্যাক্সের টিকার জন্য অর্থসংস্থান করা হচ্ছে। এর বাইরেও আরও কয়েকটি টিকার জন্য যোগাযোগ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ কয়েকটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ডাটাসহ আবেদন করেছে। তারা যদি আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের টিকার অনুমোদন দেয়, তাহলে আমাদের জন্য টিকা পেতে আরও সহজ হবে। কোভ্যাক্সের মাধ্যমেও আমরা যোগাযোগ করতে পারি আবার সরকারিভাবে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমেও টিকা পেতে পারি।
ঢাকা পোস্ট : করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি কেমন?
মুশতাক হোসেন : করোনা মোকাবিলায় আমরা বারবার হাসপাতাল, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর প্রস্তুতির কথা বলছি। কিন্তু আমি মনে করি, এ মুহূর্তে প্রস্তুতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনা। যারা নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের থেকে যেন ভাইরাসটি নতুন কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, অফিস-আদালতে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তিনি পরীক্ষা না করিয়ে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো ঘুরছেন-ফিরছেন। এমনকি মাস্কও ব্যবহার করছেন না।
স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত আপাতত করোনা পরীক্ষা এবং হোম আইসোলেশনের দিকে গুরুত্ব দেয়া। বাসা-বাড়ি, সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে সরকারি দায়িত্বে গণহারে পরীক্ষা করানো উচিত। তাহলেই প্রকৃত অবস্থাটা জানা যাবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আপনি যদি আইসিইউ বেড দ্বিগুণও করেন, সেইসঙ্গে সংক্রমণও যদি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে, তাহলে তো সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। আমি বলছি না প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার নেই, প্রস্তুতিও নিতে হবে। আইসিইউ সংখ্যা কম থাকলে সেটা বাড়াতে হবে। যেসব হাসপাতালে, বিভাগে ও জেলায় আইসিইউ সাপোর্ট নেই, সেগুলোতে দ্রুত আইসিইউ’র ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত আপাতত করোনা পরীক্ষা এবং হোম আইসোলেশনের দিকে গুরুত্ব দেয়া। বাসা-বাড়ি, সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে সরকারি দায়িত্বে গণহারে পরীক্ষা করানো উচিত। তাহলেই প্রকৃত অবস্থাটা জানা যাবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যাবে
ডা. মুশতাক হোসেন, প্রধান উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
ঢাকা পোস্ট : ইউরোপে করোনার নতুন স্টেইন শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে এর অবস্থা কী এবং এক্ষেত্রে করণীয় কী?
মুশতাক হোসেন : ভাইরাসের রূপ সবসময়ই পরিবর্তিত হয়। এটার জন্য নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভাইরাসের পরিবর্তিত রূপ সব জায়গাতেই দেখা যায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনার নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। তবে যেহেতু ইউরোপে এখন সংক্রমণটা অনেক বেশি, সে কারণে তারা সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে এটার সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশেও পরিবর্তনটা পাওয়া গেছে, তবে এখনও ভাইরাসের অস্বাভাবিক কোনো আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। যে কারণে বাংলাদেশে রূপ পরিবর্তনের কোনো আলোচনা দেখা যায় না।
ঢাকা পোস্ট : ইউরোপে করোনার রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবর্তনের কোনো মিল আছে কি-না?
মুশতাক হোসেন : কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিল থাকবে না, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিল থাকতেই পারে। তবে, ইউরোপের বর্তমান অবস্থার মতো কিছু বাংলাদেশে ঘটেনি। আমাদের সংক্রমণ চলছে, প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। শনাক্তের হার ১০ থেকে ১৫- এর মধ্যে সবসময় আছে। ইউরোপের দেশগুলোতে শনাক্তের সংখ্যা প্রায় কমে গিয়েছিল। আমরা তো আগের অবস্থাতেই আছি। তাদের যেমন হঠাৎ করে আক্রান্তের সংখ্যা আবারও বেড়ে গেছে, তেমনিভাবে বাংলাদেশে বিশেষ কিছু হয়নি।
ইউরোপের দেশগুলোতে হঠাৎ করোনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ক্রিসমাসের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে কি-না, সেটা আমাদের ভাবাচ্ছে। করোনার এমন পরিস্থিতিতেও ওই দেশগুলোতে ক্রিসমাস উপলক্ষে প্রচুর মানুষ বাইরে বের হন, উৎসবের জন্য দোকান-পাট খুলে দেয়া হয়, বিপণিবিতানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। এখন আবার নতুন করে ভাইরাস আসার পর সব বন্ধ করে দিয়েছে।
আমাদের দেশেও পরিবর্তনটা পাওয়া গেছে, তবে এখনও ভাইরাসের অস্বাভাবিক কোনো আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। যে কারণে বাংলাদেশে রূপ পরিবর্তনের কোনো আলোচনা দেখা যায় না
ডা. মুশতাক হোসেন, প্রধান উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
ঢাকা পোস্ট : সংক্রমণ বাড়লে আমাদের চিকিৎসার প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত?
মুশতাক হোসেন : যারা শনাক্ত হবেন, তাদের আইসোলেটেড করে রাখতে হবে। যাদের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেবে, তাদের ঘরে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা দরিদ্র, ঘরে থাকতে পারবেন না, তাদের সরকারি আইসোলেশন কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, যেন ভাইরাসটি সবার মধ্যে না ছড়ায়। যারা বাসায় আইসোলেটেড থেকে চিকিৎসা নেবে, তারা যেন অবস্থা জটিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে যায়। অনেকে জটিল অবস্থাটা বুঝতে না পেরে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যান, ফলে চিকিৎসকরাও জটিলতা এড়াতে পারেন না।
পাশাপাশি আমাদের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কারণ জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের আইসিইউ বেড, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা এমনিতেই কম। করোনাকে কেন্দ্র করে আইসিইউ বেড নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। কাজেই যেসব আইসিইউ বেড কিছুদিন আগে বন্ধ করা হয়েছিল, সেগুলো ফের চালু করা দরকার।
টিআই/এমএআর