কিডনি প্রতিস্থাপনে জটিলতায় দেশের বাইরে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকা
কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে জটিলতা থাকায় বছরে হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিকল কিডনির সর্বোত্তম চিকিৎসা হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু দেশে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে বেশিরভাগ রোগী একজনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায় ভারত, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকায়। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিদেশে ব্যয় হয়।
বুধবার (১৬ জুন) রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো জাতীয় বাজেট ২০২১-২০২২ পর্যালোচনায় তিনি এ কথা বলেন। এসময় তিনি এই বাজেটকে 'অর্থমন্ত্রীর ভানুমতির খেলা' বলেও অভিহিত করেন।
বিজ্ঞাপন
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, দেশে প্রয়োজন প্রতিবছর ১০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন, কিন্তু প্রতিস্থাপন হয় ২০০ এর অনধিক। এজন্য মূলত দায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
তিনি বলেন, হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন যে, নিকট আত্মীয় ছাড়াও অনাত্মীয় ব্যক্তি বা বন্ধুর জন্য যে কেউ স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে পারবেন। কিন্তু তারা গত দু’বছরেও হাইকোর্টের নির্দেশ পালন করছেন না।
কিডনি রোগীপ্রতি ১ হাজার টাকা সরকারি ভর্তুকি দাবি জাফরুল্লাহর
দেশে অন্যান্য রোগের তুলনায় কিডনি রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। ফলে কারও বিকল কিডনি সমস্যা হলে ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিন বছরের মাথায় রোগী সর্বশান্ত হন বলে জানিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ।
তিনি বলেন, ব্যয়বহুল এই চিকিৎসায় সব দরিদ্র বিকল কিডনি রোগীকে প্রতি হেমোডায়ালাইসিসের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এক হাজার টাকা ভর্তুকি দেওয়া উচিত। বর্তমানে সরকার ভারতীয় একটি কোম্পানি ‘স্যানডর’কে প্রতি রোগীর হেমোডায়ালাইসিসের জন্য ২ হাজার ২০০ টাকা ভর্তুতি দিয়ে থাকে বিগত ৫ বছর ধরে। এতেও দেশের কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।
সব মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি
গণস্বাস্থ্যের এই ট্রাস্টি বলেন, সব মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর (অ্যানালাইজার, ক্যাথল্যাব, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ডিফিবরিলেটর, ভেন্টিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর, সিটি এপারাটাস হাসপাতাল শয্যা, ব্লাড ব্যাংক, সিরিঞ্জ পাম্প, সার্জিকেল স্টেরাইল গ্লোভস, বায়োসেফটি কেবিনেট প্রভৃতি) ওপর সব ধরনের শুল্ক, অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স, এজেন্সি ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নিন।
তিনি বলেন, হেমোডায়ালাইসিসের প্রত্যেক রোগীর জন্য একটি ব্লাড টিউবিং ব্যবহার করতে হয়, তার ট্যাক্স ছিল ২৫ শতাংশ, তা কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছেন, এজন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
কমছে না ওষুধের মূল্য
জাফরুল্লাহ বলেন, ভালো কাজ করেছেন স্থানীয়ভাবে ওষুধ শিল্পের প্রায় সব কাঁচামালের (Active Pharmaceutical Ingredient-API) রেয়াতি সুবিধা দিয়েছেন। দেশের এপিআই উৎপাদিত হলে সব ওষুধ কোম্পানিকে স্থানীয় এপিআই কোম্পানি থেকে কাঁচামাল কেনা বাধ্যতামূলক করুন। অন্য কোথা থেকে আমদানি করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯২টি দেশে ওষুধের কাঁচামাল রফতানির যে তথ্য দিয়েছেন তা সঠিক নয়। বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করে, ওষুধের কাঁচামাল রফতানি করে না।
প্রত্যেক এপিআই কোম্পানিকে রফতানির জন্য আগামী ৫ (পাঁচ) বছর ২৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত ভারত ও চীনের উৎপাদক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য অর্জনের জন্য।
১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি প্রয়োগের দাবি
জাফরুল্লাহ বলেন, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ক্যানসার ও হৃদরোগের কয়েকটি ওষুধে রেয়াতি সুবিধা দিয়েছেন, এতে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা লাভবান হবেন, কিন্তু ওষুধের দাম কমবে না। ফলে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ওষুধের মূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে হলে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির অধ্যাদেশের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়মাবলী যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ১১৭টি টিকা, পরিবার পরিকল্পনার ওষুধ সামগ্রী ছাড়া অন্য সব ওষুধের মূল্য ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো নিজেরা সরাসরি স্থির করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে জানিয়ে দেয়। ওষুধ প্রশাসন কেবল মুসক (ভ্যাট) যুক্ত করে ওষুধের মূল্য ঘোষণা করে। এই পদ্ধতি মূল্য নির্দেশক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে ওষুধের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ৫০ শতাংশ কমে আসবে।
সব নাগরিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করুন
তিনি বলেন, সব নাগরিকের জন্য টিকা ব্যবস্থা করতে হবে। ১৮ মাস আগে সিনোভ্যাক ও স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন আনার ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম, তখন গ্রহণ করলে প্রতি ডোজ ২-৪ ডলারে পেতে পারতেন। এখন ৮ থেকে ২০ ডলার দিয়ে কিনতে হবে।
আমি ড. ইউনূসকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ট্রিপস চুক্তির অধীনে বাধ্যতামূলক লাইসেন্সের আওতায় এর সুবিধা নিয়ে নিজেদের ভ্যাকসিন তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলাম। এতে রয়েলটিসহ উৎপাদনে খরচ পড়ত ৫০ সেন্ট থেকে দুই ডলার মাত্র। এই পরামর্শও সরকার নেয়নি।
জাফরুল্লাহ বলেন, ২ কোটি স্পুটনিক-ভি টিকা পাওয়া যাবে ৮ ডলারে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কুইক রেন্টাল বাতিল করে দিয়ে যে টাকা সাশ্রয় হবে, তা দিয়ে সব নাগরিকের টিকার ব্যবস্থা করা যাবে। টিকা মৃত্যু ও সংক্রমণ উভয় কমায় এবং কর্মদক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। তদুপরি সুলভ সুদে সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করার নিমিত্তে বিশ্ব ব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলার ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকেও টিকা ক্রয়ের জন্য সহায়তা পাওয়া যাবে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন চিকিৎসককে পাওয়া যায় না
তিনি বলেন, দেশে প্রায় অরক্ষিত ৫ হাজার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, প্রায় ৪৫০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১৪ হাজার ৩৮৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং কয়েকশ জেলা, বিভাগ ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে। কেবলমাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কয়েকজন চিকিৎসকের উপস্থিতি দেখা যায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন চিকিৎসককে পাওয়া যায় না। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে বসবাসকারী ৭০-৭৫ শতাংশ জনগণের ২০ শতাংশ রোগীর ভাগ্যে মৃত্যুর আগেও একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের দর্শনের সৌভাগ্য হয় না।
অর্থমন্ত্রী সব সরকারি মেডিকেল কলেজ, ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যানসার হাসপাতাল, সব জেলা হাসপাতালে নেফ্রোলচি ইউনিট ও কিডনি
সেন্টার, ৩৩টি হাসপাতালে অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, ইউনিয়ন পর্যায়ে ১০ শয্যাবিশিষ্ট এমসিডবলিওসি, মাতৃ ও শিশু সেবা কেন্দ্রের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার বাইরে অন্যান্য সব জেলায় ১০ বছরের কর অব্যাহতির ভিত্তিতে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য, অনকোলজি (ক্যানসার) প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের ২৫০ শয্যার সাধারণ হাসপাতাল এবং ন্যূনতম ২০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরির জন্য দশ বছসর আয়কর রহিত করছেন। কিন্তু এগুলো চালাবেন কারা?
জাফরুল্লাহ বলেন, সরকারি হাসপাতালে সব চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হলে, কেবল বরাদ্দ বাড়ালে চলবে না, কতকগুলো মৌলিক পরিবর্তন কার্যকর করতে হবে। নিয়ম করতে হবে কোন সরকারি চিকিৎসক, কোন বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে কাজ করতে পারবেন না। সব অবকাঠামোর উন্নতি করতে হবে, হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রাচীর, গভীর নলকূপ, ইলেকট্রিক সাবস্টেশন, সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নার্স, টেকনিশিয়ান, ডেন্টিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট ও চিকিৎসকদের বাসস্থান, ছাত্রদের জন্য ডরমিটরি, দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বাসস্থান নির্মাণ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে থাকাকে নিরাপদ ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
টিআই/জেডএস