ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত “ঢামেকের দেয়ালে প্রতিবাদী ব্যানার-পোস্টার: ড্যাব নেতাদের ‘হাত ধরে’ ঢামেকে আওয়ামীপন্থিদের পদায়ন!” শীর্ষক সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন পদায়ন পাওয়া তিন চিকিৎসক। প্রতিবাদে উল্টো নিজেদের ‘বিএনপিপন্থি’ চিকিৎসক বলেও দাবি করেছেন তারা। এমনকি তাদের এ পদায়ন পাওয়ার পেছনে ঊর্ধ্বতন ড্যাব নেতাদেরও কোনো ‘হাত নেই’ বলে প্রতিবাদে উল্লেখ করেছেন।

রোববার (২৪ নভেম্বর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সদ্য পদায়ন পাওয়া ডা. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ডা. মনিরুল ইসলাম নয়ন ও ডা. মো. সাজিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ঢাকা পোস্টে পাঠানো পৃথক তিনটি প্রতিবাদলিপিতে এমন দাবি করা হয়।

এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন দেওয়ালে উক্ত তিন চিকিৎসকসহ সর্বমোট চার চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আওয়ামী সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে প্রতিবাদী ব্যানার-পোস্টার লাগানো হয়। বিষয়টি নিয়ে গত ২০ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঢাকা পোস্ট। প্রতিবেদনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক ও চিকিৎসকবৃন্দের নামে সাঁটানো ব্যানার-পোস্টারে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়। এসব ব্যানার-পোস্টারে বলা হয় ‘এরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতার বিচারকার্যে বাধাপ্রদানকারী ফ্যাসিস্ট ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও স্বাচিপের দালাল। তাদের পদায়ন বাতিল ও পদায়নের সঙ্গে জড়িতদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক ও চিকিৎসকবৃন্দ।’

যুবলীগ-স্বাচিপ নেতারা ‘জোরপূর্বক’ বাধ্য করেন, দাবি ডা. মনিরুলের

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যুবলীগ ও স্বাচিপ নেতারা জোরপূর্বক তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে যেতে বাধ্য করেন বলে দাবি করেছেন পদায়ন পাওয়া চিকিৎসক ডা. মনিরুল ইসলাম নয়ন। তিনি বলেন, উপরোক্ত সংবাদের ভিত্তি হলো একটি ফটোফ্রেম, যা ২০২০ সালের। ওই সময় আমার পোস্টিং ছিল বগুড়া সদর হাসপাতাল। কতিপয় যুবলীগের নেতা ও স্বাচিপ সদস্য কর্তৃক আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে হেনস্থার শিকার হই এবং আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক এটি করানো হয়।

তিনি বলেন, তখন বলা হয় আমি নাকি বিএনপিপন্থি এবং তারা এলাকায় কিছু কার্যক্রমের প্রমাণও পায়। এর কিছুদিন পরে আমি ফটোফ্রেমটা সরিয়ে ফেলি। এরপর আওয়ামী লীগের কোনো কর্মকাণ্ডে আমাকে নিয়ে যেতে পারেনি।

ডা. মনিরুল দাবি করেন, আমার বাসা বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর উপজেলায়। যা বগুড়া-৭ আসনের অন্তর্ভুক্ত এবং এটা বরাবরই জিয়া পরিবারের আসন হিসেবে পরিচিত। আমিসহ আমার পুরো পরিবারই সবসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই, সব সিনিয়র নেতা আমার পোস্টিংয়ের ব্যাপারে যুক্ত আছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আসলে তারা এ ব্যাপারে যুক্ত নন।

পদায়ন পেতে স্বাচিপ নেতাদের সঙ্গে ছবি তোলার দাবি ডা. সাজিদুলের

সদ্য পদায়ন পাওয়া আরেক চিকিৎসক হলেন ডা. মো. সাজিদুল ইসলাম। তিনিও নিজেকে জাতীয়তাবাদী দলের কনিষ্ঠ সমর্থক দাবি করেন। প্রতিবাদলিপিতে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্য ক্যাডারে বাধ্যতামূলক দুই বছর মফস্বল পর্যায়ে কাজ করতে হয়। আমার প্রায় পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছিল। আমার জুনিয়র ব্যাচের সহকর্মীরাও বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পদায়িত হচ্ছে। ব্যাপারটি ক্রমাগত আমাকে খুব পীড়া দিতে থাকে।

ডা. মো. সাজিদুল বলেন, আমি ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পদায়নের জন্য দরখাস্ত করতে থাকলেও আমার পদায়ন হচ্ছিল না। এর মধ্যেই আমার পিতা আকস্মিক রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, যা আমাকে আরও হতাশায় নিমজ্জিত করে। উপায়ন্তর না দেখে আমি ঢামেকের যারা পোস্টেড চিকিৎসক (স্বাচিপ) আছেন, তাদের কয়েকজনের কাছে বাধ্য হয়ে পদায়নের বিষয় পরামর্শ নিতে যাই ২০২৩ সালের জানুয়ারির এক-দুই দিন। তখন বাধ্য হয়ে সৌজন্যমূলক ১/২টি ছবি তুলতে হয়। যা কখনোই প্রমাণ করে না পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদ সরকারের কোনো অঙ্গ-সংগঠনের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা।

তিনি আরও বলেন, পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদ সরকারের কোনো সংগঠনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। এমনকি আমি ছাত্র ও চাকরিজীবনে কোনো সুবিধাপ্রাপ্তও নই। তা হলে কীভাবে বিগত সরকারের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়? বরং গত জুলাই-আগস্ট মাসে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করি অনলাইন প্লাটফর্মে।

সাজিদুল আরও বলেন, চাকরিজীবনের প্রায় পাঁচ বছর পর গত ৫ আগস্ট আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পদায়িত হই। তারপর থেকে একটি কুচক্রী মহল হিংসাত্মক ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অন্যায় অপপ্রচারে লিপ্ত হয় যা আমার জন্য চরম মানহানিকর। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমার পরিবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং আমার নানা মরহুম আবদুল মতিন খান (বাদল) টাঙ্গাইলের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন কর্মী ও সংগঠক ছিলেন।

ঊর্ধ্বতনদের ‘যৌক্তিক আদেশ’ মানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়েছিলাম : ডা. মাসুদ

ডা. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ তার প্রতিবাদলিপিতে উল্লেখ করেন, গত ২০ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত ড্যাব নেতাদের ‘হাত ধরে’ ঢামেকে আওয়ামীপন্থিদের পদায়ন সংবাদে আমার সম্পর্কে ভিত্তিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে আমার ব্যাখ্যা প্রদান করছি। ওই সংবাদের ভিত্তি একটা ভিডিও। আমি কোভিডের সময় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কোভিড ইউনিটে কাজ করব এ শর্তে যোগদান করি। পরবর্তীতে তিন বছর সার্জারিতে কাজ করি। যেহেতু তখন প্রাথমিক অবস্থায় কোভিড ইউনিট কার্যকর ছিল না। পরবর্তীতে প্রমোশন পেয়ে অনেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমি মেডিসিনে কাজ শুরু করি।

তিনি বলেন, ৪ আগস্ট আমি বহির্বিভাগে রোগী দেখছিলাম। এমতাবস্থায় হাসপাতালের পরিচালক ও অন্যান্য সিনিয়র চিকিৎসক বহির্বিভাগ থেকে আমাকে ডিজি অফিসে একটি মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ করেন। আমি চাকরিনীতি অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যে কোনো যৌক্তিক আদেশ মানতে বাধ্য হওয়ায় উক্ত মিটিংয়ে যোগদান করি। এমন সময় তৎকালীন ডিজি অ্যাডমিনের নেতৃত্বে শ্লোগানসহ হঠাৎ সরকারের পক্ষে মিছিল শুরু হয়। আমরা কয়েকজন ওই অবস্থায় ডিজি অফিসের সামনে থেকে হেঁটে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যাই এবং ওখান থেকে হাসপাতালের দিকে চলে আসি। ওই সময় একটি ধারণ করা ভিডিও দেখিয়ে আমিসহ বক্ষব্যাধি হাসপাতালের কিছু মিড লেভেলের চিকিৎসককে দেখানো হয় যে আমরা মিছিল করেছি এবং আমরা ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষে।

আল মাসুদ আরও বলেন, উক্ত হাসপাতালে চার বছর কাজ করলেও কোনো রকম স্বাচিপ বা সরকারি কোনো কমিটি, কোনো সমাবেশে কখনই যাইনি। শুধুমাত্র ডিজি অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়কার ভিডিও ধারণ করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল অনবরত আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি সমগ্র চাকরিজীবনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাচিপ অথবা আওয়ামী লীগ সমর্থক কোনো অঙ্গ-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি আগাগোড়া জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষে বিভিন্নভাবে আমার অবস্থান জানিয়ে গেছি এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি।

পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত দাবি করে এ চিকিৎসক বলেন, আমার মা আমিনা খাতুন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের ঢাকা মহানগর শাখার ২০১৫-২০২১ সাল পর্যন্ত জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন এবং উনি বিএনপির হয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৪, ১৫ ও ১৬ ওয়ার্ড থেকে বিএনপি থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। এ ক্ষোভ থেকে বিগত সরকারের সময় আমার মায়ের নামে ৩৬টি মামলা করা হয়। আমার স্ত্রী বিএনপি করার জন্য সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হন। উল্লেখ্য যে, ১/১১ এর সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপের প্রথম ভিকটিম হয়ে গ্রেপ্তার হন আমার মামা ১৬নং ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ কাইয়ুম খান। ১৩ মাস বিনা অভিযোগে, বিনা চিকিৎসায়, বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক অবস্থায় কারাভ্যন্তরে শাহাদাত বরণ করেন। সেই সঙ্গে নেমে আসে আমার পরিবারের ওপর নানা অত্যাচারের খড়গ। বাবার ও ভাইয়ের সব ব্যবসা ও ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হয়। এ ধরনের ভিডিও যারা দিচ্ছে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী প্ল্যাটফর্মে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য আমাদের মাঝে বিভাজন ও দ্বন্দ্ব তৈরি করা।

প্রতিবেদকের বক্তব্য

ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত “ঢামেকের দেয়ালে প্রতিবাদী ব্যানার-পোস্টার: ড্যাব নেতাদের ‘হাত ধরে’ ঢামেকে আওয়ামীপন্থিদের পদায়ন!” শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রতিবেদকের নিজস্ব অনুসন্ধান নয়। প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের কোনো নিজস্ব বক্তব্যও নেই। ঢামেকের বিভিন্ন দেওয়ালে চিকিৎসকদের সাঁটানো প্রতিবাদী ব্যানার-পোস্টার তুলে ধরেই মূলত প্রতিবেদনটি করা হয়েছে, যেখানে বিগত সরকারের সময়ে অবহেলিত ও হাসপাতালটিতে কর্মরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রতিবেদনে উল্লিখিত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে বিভিন্ন সময়ে মিছিল-মিটিংয়ের নানা ছবি ও ভিডিওসহ বিভিন্ন প্রমাণ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই।

টিআই/