দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হওয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা পছন্দ মতো মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা হতাশ ও সংক্ষুব্ধ।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অনেক আসনই ফাঁকা থেকে যাচ্ছে অটোমেশন ভর্তি প্রক্রিয়ায়। অটোমেশনের নামে বেসরকারি মেডিকেল খাতকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে দাবি করেছেন সচেতন অভিভাবক ও বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। ফলে অটোমেশন পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তিতে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হয়। এ পদ্ধতিতে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মেধাতালিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের কলেজগুলো বেছে নিতে পারেন না। এতে প্রথমে শিক্ষার্থীদের পাঁচটি মেডিকেল কলেজে ভর্তির চয়েস রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে এ নীতি পরিবর্তন করে ছেলেদের জন্য ৬০টি মেডিকেল কলেজ এবং মেয়েদের জন্য ৬৬টি চয়েস রাখা হয়েছে।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, বেসরকারি মেডিকেল সেক্টর ধ্বংস করার জন্য অটোমেশন চালু করা হয়েছে। বিগত সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এ অটোমেশন চালু কার হয়েছে। শিক্ষার মান রক্ষার নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কর্মকর্তারা নিজেদের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। সরকারই বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়েছে এবং নীতিমালাও করে দিয়েছে। সেই নীতিমালা ও গাইডলাইন কেউ না মানলে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। সরকারের পাশাপাশি অনেক নামিদামি বেসরকারি হাসপাতাল আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত কিংবা বেশির ভাগ বিত্তশালী এখন দেশেই চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। প্রাইভেট মেডিকেল সেক্টর ধ্বংস করে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের তৎকালীন অদক্ষ, অযোগ্য ও ঘুসখোর কর্মকর্তারা তাদের আয়ের উৎস বাড়াতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করেছে। নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে তারা নতুন এ আইন চাপিয়ে দিয়েছে। এ পদ্ধতি চালু হওয়ার পরে প্রতি শিক্ষাবর্ষে অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সকল আসন পূরণ হয়নি বরং সিংহভাগ আসনে শিক্ষার্থী শূন্য রয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রমেও।

ভর্তির ক্ষেত্রে অটোমেশন পদ্ধতির সমস্যাসমূহ

এমবিবিএস ভর্তিতে নির্ধারিত আসনের চারগুণ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও অটোমেশন পদ্ধতির কারণে নিজেদের পছন্দের মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। ফলে চিকিৎসা শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে অটোমেশন পদ্ধতির বেশকিছু সমস্যা লক্ষ্য করা গেছে।

শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার বাড়ছে

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চাপিয়ে দেয়া এ অটোমেশন পদ্ধতির বলি হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। এ নীতির কারণে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা পছন্দ মতো মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশ ও সংক্ষুব্ধ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৈরি ভর্তি-ইচ্ছুক তালিকায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা ঢাকার বাইরে গ্রামে-গঞ্জের কোনো মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীর ফ্যামিলি সেখানে ভর্তি করতে চাচ্ছে না, যেখানে মানিয়ে নেয়া তাদের সন্তানের পক্ষে কষ্টসাধ্য। আবার মফস্বলের অনেকে রাজধানীতে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এখানকার ব্যয় বহন তাদের পক্ষে কঠিন। এভাবে অটোমেশন পদ্ধতি একাধিক শিক্ষার্থীর ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছে।

পছন্দের মেডিকেলে ভর্তি উপেক্ষিত

অটোমেশন পদ্ধতিতে অনলাইনে বেসরকারি মেডিকেল ভর্তির জন্য ফরম পূরণের সময় কলেজের তালিকা যুক্ত করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী আবেদনের পর একটি নির্দিষ্ট মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে জানানো হয়। ফলে তাদের পছন্দের বিষয়টি থাকছে না। পছন্দের মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ার শিক্ষার্থীরা ডাক্তারি পড়ালেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

আসন শূন্য থাকা

অটোমেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ মতো কলেজ না পাওয়ায় ভর্তি হচ্ছে না। ফলে বছরের শেষভাগেও অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন শূন্য থাকছে। আসন শূন্য থাকায় ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে অটোমেশনে তিনবার মেধা তালিকা প্রেরণ করা হলেও অনেকে তাদের পছন্দের কলেজ না পেয়ে ভর্তি হয়নি। এমনকি বিনা খরচে দরিদ্রও মেধাবী কোটাতেও পছন্দ মতো কলেজ না পাওয়ায় আসন পূরণ হচ্ছে না কোথাও কোথাও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী এক লাখ দুই হাজার ৩৬৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ৪৯ হাজার ৯২৩ জন ভর্তিচ্ছু। তাদের মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেলে পাঁচ হাজার ৩৮০ সিট পূর্ণ হলেও ৬৭টি অনুমোদিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছয় হাজার ২৯৫টি আসন পূরণ হয়নি। চলতি বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এক হাজার ২০০ সিট খালি রয়েছে। এ ছাড়া ভর্তি প্রক্রিয়া এখনও চলমান, যা শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বিলম্বে ক্লাস শুরু

অটোমেশনে ভর্তি প্রক্রিয়া অনেক সময়সাপেক্ষ। কয়েকবার মেধা তালিকা প্রকাশের পরেও আসল ফাঁকা থাকায় বিলম্বে ক্লাস শুরু করতে হচ্ছে। এ ছাড়া প্রথমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হওয়ার পরেও অনেকে এখান থেকে চলে যাচ্ছে আবার অনেকে পরবর্তী তালিকা অনুযায়ী ভর্তি হচ্ছে। ফলে ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের কলেজ না পেয়ে ভর্তি হচ্ছে না আবার অন্য কোথাও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।

অটোমেশন পদ্ধতির কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অটোমেশন চালু করার আগে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থীরা ডাক্তারি পড়তে আসতেন। অটোমেশন কাউকে তার ইচ্ছা মতো খুশি করতে পারছে না। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও বাংলাদেশে মেডিকেলে ভর্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, বিগত ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে বিদেশি শিক্ষার্থী ৪৫ শতাংশ সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে মেডিকেল শিক্ষা খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে না।

মাহবুব রায়হান নামের এক অভিভাবক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আমার মেয়ে দূরবর্তী জেলার একটি সরকারি মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় মেয়েকে রাজধানীর কোনো একটি প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু অটোমেশন পদ্ধতি চালুর কারণে আমার মেয়েকে সরকারি মেডিকেলে ভর্তি করতে ব্যর্থ হয়েছি। এ পদ্ধতির কারণে বেসরকারি মেডিকেলে আমার মেয়ের ভর্তির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। আর এখানেই শেষ হয়ে গেছে তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। যেখানে মানুষের পছন্দ-অপছন্দ বলে কিছু থাকে না, সেই নিয়মের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমার মেয়ের মতো অনেকের সন্তানের স্বপ্নভঙ্গ হওয়া এ অটোমেশন পদ্ধতি বাতিল করা হোক।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আরেক অভিভাবক বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারি মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে ভর্তিতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করতে পারে কিন্তু বেসরকারিতে অটোমেশন মানেই মানুষের অধিকার হরণ করা। যারা বেসরকারিতে পড়বে তারা টাকা দিয়েই পড়বে, যেখানে খুশি সেখানেই পড়বে। এটা নিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ হাবিবুল হক বলেন, অটোমেশন পদ্ধতিটি ভারত থেকে আনা হয়েছে। এটি নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের বিষয়ে অন্য দেশের পরিস্থিতি আর আমাদের পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়নি। সেখানে অটোমেশন প্রয়োজন। আমাদের দেশে তো সে রকম না।

তিনি আরও বলেন, একজন শিক্ষার্থী ঢাকায় বেড়ে উঠেছে, পড়াশোনা করেছে এবং ঢাকার যে কোনো একটি মেডিকেলে পড়তে তার সামর্থ্য আছে। তাকে তার পরিবার টাকা দিচ্ছে। তাকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বরিশাল। এখন ঢাকার ছেলে কি বরিশাল গিয়ে অথবা অন্য কোনো জেলায় গিয়ে পড়বে? সে মেডিকেলে পড়ার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে, নয়তো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অথবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।

অটোমেশন একটি বৈষম্যমূলক পদ্ধতি, এটি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সংগঠনটির পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছে, বেসরকারি মেডিকেলের মতো ব্যয়বহুল শিক্ষায় যারা পড়তে ইচ্ছুক, তারা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে নিজেদের পছন্দের কলেজে পড়তে চান। অটোমেশনের কারণে অর্থ থাকলেও পছন্দের কলেজে অনেকেই ভর্তি হতে পারছেন না। অটোমেশন পদ্ধতি বাতিল করে আগের ব্যবস্থায় ফিরে গেলে শিক্ষার্থী ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সুবিধা হবে।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর বলেন, অটোমেশনের নামে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তিতে বড় বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, মালিকপক্ষ এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ পদ্ধতি যেন বেসরকারি মেডিকেল সেক্টর ধ্বংসের হাতিয়ার না হয় সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, অটোমেশন পদ্ধতিতে মেডিকেলে ভর্তি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অনেক মেধাবী পছন্দের কলেজ না পেয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। সুতরাং সব পক্ষের সুবিধার জন্য পুরাতন পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি।

এমএআর/