জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকার ও বাধা প্রদানকারী স্বৈরাচারের দোসর চিকিৎসকদের বিএমডিসি নিবন্ধন বাতিলসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা। তাদের দাবি, গণ-অভ্যুত্থানের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে সাবেক উপাচার্যের একান্ত সচিব ও সাবেক প্রক্টরের নেতৃত্বে একদল আওয়ামী সন্ত্রাসী শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করে। দ্রুততম সময়ে তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডা. মিলন হলে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বিএসএমএমইউ’র সভাপতি ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. রুহুল কুদ্দুস (বিপ্লব)। এসময় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) বিএসএমএমইউ শাখা সভাপতি ডা. আতিয়ার রহমানসহ আরও অনেকে।

সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য কিছু দাবি উপস্থাপন করা হয়। সেগুলো হলো-

১. আহত ছাত্র-জনতাকে যারা চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকার ও বাধা দিয়েছে তাদের তালিকা প্রণয়ন করে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। শান্তি সমাবেশে যোগদানকারী ও ফ্যাসিবাদের দোসর সব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. গত ১৬ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সব দুর্নীতি ও অনিয়মের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে এবং সব কেনাকাটা, টেন্ডার ও নির্মাণে অনিয়মের তদন্ত করে বিচার করতে হবে।

৩. এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের কারণে যেসব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী চাকরিচ্যুত, পদাবনতি ও বরখাস্ত হয়েছেন তাদেরকে স্ব-স্বপদে বহালের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি এবং উচ্চ শিক্ষা অর্জনে যে বৈষম্যমূলক বাধা প্রদান করা হয়েছে তা দূর করতে হবে।

৪. বৈষম্যের শিকার সব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদেরকে অতি দ্রুত ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দিয়ে বৈষম্য দূর করতে হবে।

৫. বিগত ৪ আগস্ট ২০২৪ তারিখ গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে সাবেক উপাচার্যের একান্ত সচিব এবং সাবেক প্রক্টর এর নেতৃত্বে একদল আওয়ামী সন্ত্রাসী শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী পরিকল্পিতভাবে শাহবাগের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রসহ আক্রমণ করে বহু ছাত্র-জনতাকে হতাহত করে এবং আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও ভস্মীভূত করার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও মামলা দায়ের করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৬. সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত থেকে শুরু করে স্বৈরাচার কর্তৃক নিয়োগকৃত সব ভিসি, প্রো- ভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরদের এবং অন্যান্যদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের হিসাব দুদকের মাধ্যমে তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা কনভেনশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে অতিসত্বর মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

৮. বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের আতুর ঘর হিসাবে বিবেচিত মুজিববাদ প্রেরণার উৎস হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অনতিবিলম্বে পরিবর্তন ও ৫ আগস্টের বিপ্লবের চেতনা বিরোধী সব ম্যুরাল ও মূর্তি সরিয়ে ফেলতে হবে।

৯. এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরে সংঘটিত সব অনিয়ম, দুর্নীতির ও বৈষম্য তদন্তে একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করতে হবে।

১০. ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের পদোন্নতি সংক্রান্ত ২০০৮ সালের প্রজ্ঞাপন ২০০৯ সালের ৩৩তম সিন্ডিকেট সভায় বাতিল করার আদেশটি অনতিবিলম্বে বাতিল করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দিতে হবে।

সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তারা বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি ও শিক্ষক, কর্মকর্তা, নার্স এবং কর্মচারীদের সঙ্গে  যে ধরনের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য হয়েছে, তা নজিরবিহীন। তবে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পলায়নের পর আমরা নতুন এক স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

বক্তারা বলেন, বিগত ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার এদেশে একটি মাফিয়া শাসন কায়েম করেছিল। মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের প্রকৃত সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীরা।

এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত প্রশাসনের আওয়ামী দোসররা আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসা দিতে বাধা দেওয়াসহ পুলিশি হয়রানি করা হয়েছে। গত ৩ আগস্টে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সি-ব্লকের সামনে চিকিৎসকের অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে ২ জনকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ আগস্টে জ্বালাও পোড়াও এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। এসব ঘটনায় বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শিগগিরই সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমরা প্রকাশ করব এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নেব।

তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এবং বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা কনভেনশন সেন্টার নির্মাণে ভয়াবহ দুর্নীতির করা হয়েছে, ফলে আজ তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ২০০৬ সালের আগে নিয়োগ করা শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের যে হয়রানি, চাকরিচ্যুতি, পদাবনতি ও উচ্চ শিক্ষা অর্জনের বাধা প্রদান এবং বৈষম্যের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, চিকিৎসা ও গবেষণাকে ধ্বংস করা হয়েছে। আগামী ২ নভেম্বর আমাদের সিন্ডিকেট মিটিং রয়েছে, সেই মিটিং থেকে আশা করছি ভালো কিছু সিদ্ধান্ত আসবে, যার মাধ্যমে একদিকে স্বৈরাচারের দোসরদের বিচারের মুখোমুখি করা প্রক্রিয়া শুরু হবে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আবারও শিক্ষা-চিকিৎসায় হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা হবে।

টিআই/জেডএস