শেখ হাসিনার পতনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন (ড্যাব)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের সময়ে ব্যাকফুটে চলে যাওয়া সংগঠনটি এবার শুধু সক্রিয়ই নয়, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একরকম ‘চেয়ার দখলের যুদ্ধে’ লিপ্ত হয়েছে। একক ‘আধিপত্য’ বিস্তার করতে সৎ-অরাজনৈতিক এমনকি জামায়াত সমর্থিত চিকিৎসক-কর্মকর্তাদেরও ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।

রোববার (২০ অক্টোবর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশের আয়োজন করে ড্যাব। 

এসময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এবিএম আবু হানিফসহ লাইন ডিরেক্টরদের অপসারণের দাবি জানায় তারা। 

এদিকে ড্যাবের দিনব্যাপী আন্দোলনের কারণে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীই কর্মস্থলে আসতে পারেননি। ফলে অধিদপ্তরে তৈরি একধরণের হয়েছে অচলাবস্থা।

বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কোণঠাসা চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের দাবি, স্বাস্থ্য সেক্টরে কর্মরত চিকিৎসকদের বড় একটা অংশই অরাজনৈতিক পরিচয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। 

এমনকি আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপ না করার দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ নানা বঞ্চনার স্বীকারও হতে হয়েছে তাদেরকে। এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ায় বৈষম্য থেকে মুক্তির স্বপ্নও দেখছিলেন তারা। তবে, স্বৈরাচারমুক্ত নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এবার যেন নতুন ফ্যাসিবাদরূপে আবির্ভাব হয়েছে কিছু ড্যাব সমর্থিত নেতা।

একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় ড্যাব

চিকিৎসকদের একটি অংশের দাবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় রয়েছে ড্যাব। তাই আপাদমস্তক নিজেদের সমর্থক ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসকের নিয়োগ মানতে পারছে না সংগঠনটি। বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তী সরকার মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিলেও তারা বাধ সাধছেন। স্বৈরাচারের দোসরসহ বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করে কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গত ২০ আগস্ট স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের শান্ত থাকার আহ্বানও উপেক্ষা করেন তারা। তখন তাদের সামনে একজন চিকিৎসককে টেবিলের ওপর উঠতে দেখা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া ভিন্ন মতের চিকিৎসকদের অপসারণে আন্দোলনে নেমেছে ড্যাব।

ডা. নাজমুল ইসলাম নামক এক চিকিৎসক বলেন, আমরা যারা কোনোরকম দল করি না, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কি আমাদের চাকরি করার কোনো স্বপ্ন বা আশা থাকতে পারে না? এতোদিন তো দেখেছি আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করেছিলো, সেখান থেকে তো আমরা নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছি। নতুন সরকার আসায় আমরা যে বৈষম্য নিরসন হয়েছে ভেবেছিলাম, সেটি দেখেছি এখনও হয়নি।

ছাত্রদল-যুবদল নিয়ে ড্যাবের অধিদপ্তর ঘেরাও!

দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েক নেতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শাখাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক নেতাদের নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছে ড্যাব। এসময় স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদেরও দেখা গেছে। তাদের নিয়মিত অবস্থানে কার্যত স্থবির হয়ে ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

সমাবেশ থেকে অধিদপ্তরে কর্মরত অধিকাংশ স্বাস্থ্য প্রশাসককে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর আখ্যা দিয়ে তাদের পদ থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান তারা। অন্যথায় তাদের ব্যাপারে ড্যাব আপস করবে না বলে সমাবেশে জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমীনকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পুনর্বাসন চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন ড্যাব নেতারা।

আন্দোলনে আগ্রহী নয় জানিয়ে দ্রুত তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড্যাবের চিকিৎসকরা বলেন, আমরা চাই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। অন্যথায় আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হবে। 

তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মদদপুষ্ট কোনো চিকিৎসককে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। স্বাস্থ্য খাতে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা নিরসনে দ্রুততম নির্বাচন দেওয়ারও আহ্বান জানান কোনো কোনো চিকিৎসক নেতা। 

তারা বলেন, নির্বাচিত সরকারের হাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সাধিত হবে৷

এসময় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) ড্যাব নেতা ডা. খায়রুল ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন। 

তিনি বলেন, চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। আর চিকিৎসকদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ড্যাব৷ তাদের বাদ দিয়ে আপনারা কার্যক্রম চালাতে পারবেন না।

এ সময় ডা. মেহেদী হাসান নামে আরেক ড্যাব নেতা বলেন, বিতর্কিত নিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে অস্থির করা হচ্ছে। আজকের এই স্বাধীনতার জন্য ড্যাবের সকল সদস্যের ভূমিকা রয়েছে।

ড্যাবের অভিযোগ অস্বীকার নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের

ড্যাবের করা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন পরিচালক প্রশাসন ডা. এবিএম আবু হানিফ। তিনি দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আসেন, তবে আন্দোলন পরিস্থিতির কারণে কার্যালয়ে না ঢুকে আবার ফিরে যান এ স্বাস্থ্য প্রশাসক। 

এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সঠিক অভিযোগ না। আমরা যে-সব কর্মস্থলে কাজ করে এসেছি, সেগুলোতে খোঁজ নিলে আপনারা বুঝতে পারবেন।

তিনি বলেন, প্রশাসনের চেয়ারগুলোতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক কিছুর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে আমাদের কাজ করতে হয়। এগুলো এখন রেফার হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক কাজ না। আমরা যে চেতনায় বিশ্বাস করি, এর সঙ্গে এসব অভিযোগ যায় না।

এ পরিস্থিতি স্বাস্থ্যখাত অস্থির করার পাঁয়তারা কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কথাগুলো আমি এভাবে বলবো না। যে পদে আমাকে পদায়ন করা হয়েছে, সে পদে এক মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছি। আমি সবার কাছ থেকে সহযোগিতাই পেয়েছি। কোনো অসহযোগিতা পাইনি। সুতরাং এখানে কাউকে আমি আলাদা করতে রাজি না। উনারা (ড্যাব) উনাদের অবস্থান থেকে কথা বলেছেন। আশা করি, উনাদের অবস্থানও পরিষ্কার হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।

এ সময় জটিলতা লাঘবে সবার সহনশীলতা প্রত্যাশা করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক। বলেন, আশা করি ভুল বোঝাবুঝি কেটে যাবে, সবাইকে নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করবো।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. জয়নাল আবেদিন টিটো বলেন, সরকারি চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে আমি কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের মিটিং মিছিলে যাইনি। সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি। বিগত সরকারের আমলে আমাকে কুষ্টিয়ায় বদলি করা হয়েছে। সেটাকে 'সরকারের সিদ্ধান্ত' মনে করে আমি কুষ্টিয়াতে যোগদান করেছি।

তিনি বলেন, আমি সব সময় ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদার পক্ষে, এবং ফ্যাসিজমের বিপক্ষে। এ ব্যাপারে আমি উচ্চকণ্ঠ। আমি আল্লাহ'য় ও পরকালে বিশ্বাসী মানুষ, এবং এভাবেই জীবনযাপন করি। ভুল ধারণা থেকে অনেকেই ভুল বক্তব্য দিচ্ছে। তারা যদি সত্যটা সন্ধান করত, তাহলে ভুল ধারণা করতো না।

টিআই/এমএসএ